Friday, August 10, 2012

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ

১৭৬৫ সালের পর থেকেই বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা একত্রে ছিল। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা দখল করে বসেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মানুষের কাছ থেকে অর্থসম্পদ লুটপাট করা। যে কোনোভাবেই হোক না কেন খাজনা আদায়ই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। তারা একাজে স্থানীয় জমিদারদের ব্যবহার করে। সে সময়ে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সূচনা হয়। খাবারের অভাবে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মানুষ নির্মম শোষণের শিকার হয়। ফলে সে সময়
কিছু কিছু প্রজাবিদ্রোহও দেখা দিয়েছিল।
বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা যুক্ত থাকায় বাংলার আয়তন অতিরিক্ত বড় হয়েছিল। ফলে বনিক ইংরেজদের পক্ষে বড় বাংলাকে শাসন-শোষণ করা ঝামেলাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ কারণে ইংরেজরা বঙ্গকে ভাগ করার একটা পরিকল্পনা বহু পূর্ব থেকেই করে এসেছিল।

বঙ্গভঙ্গের আদিকথা
বঙ্গপ্রদেশের আয়তন ছিল সে সময় ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ছিল ৭৮,৫ মিলিয়ন। হিসাবটা ১৮৩৬ সালের। তখন বঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভৌগলিক ও অপ্রতুল যোগাযোগ ববস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।

১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে গভর্নরের উপর অর্পন করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেটসহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত করা হয়।

১৮৯৬ সালে আসামের চীফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড প্রস্তাব করেন, চট্টগ্রাম ডিভিশন ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে একটি লেফটেনান্ট গভর্নর-শাসিত প্রদেশ গঠন করা হোক—কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী স্যার হেনরী কটন ও জনগণের প্রতিবাদে কেবল লুসাই পর্বতমালা হস্তান্তর করে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়। ১৯০১ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার সম্বলপুর-সহ উড়িষ্যাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলার সীমানা-পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করলে ব্যাপারটি কার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তাঁর বিখ্যাত Round and round নোটে (২৪ মার্চ ১৯০২) সমস্ত ব্যাপারটিকে ত্বরাণ্বিত করার হুকুম দিলেন। ফ্রেজার ২৮ মার্চ ১৯০৩ সালের নোটে ওয়ার্ডের পরিকল্পনাটি উপস্থাপিত করলে কার্জন তাঁর ১ জুন ১৯০৩ তারিখের নোটে ‘একটি প্রজন্মের জন্য ভারতের শাসন-সীমানা’ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আশা প্রকাশ করলেন। এরইপর ভিত্তি করে ভারত সরকারের প্রধান সচিব হার্বার্ট রিজলে বাংলা গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারিকে তার বিখ্যাত ৩ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখের চিঠিতে Artificial agitation এবং interested outcry—এর সম্ভাবনা সত্বেও শাসনতান্ত্রিক নৈপুণ্য ও সুবিধার স্বার্থে সীমানা-পুনর্বিন্যাসের যৌক্তিকতা সমর্থন করলেন। রিজলি তার নোটে লিখেছিলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বঙ্গদেশকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসন-বিরোধীদের দুর্বল করে দেওয়া।

একটি বিষবৃক্ষের সন্ধানে
সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ইংরেজরা একটা ধাক্কা খেয়েছিল। এই বিদ্রোহকে সামাল দিতে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে প্রজাদের যোগ ছিল না। তারা উনিশ শতকের শেষভাগে প্রজাসাধারণের উত্থানকে ভয় পাওয়া শুরু করে। তবে এই উত্থানটা তখনই ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে যখন সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে আসবে। ইংরেজরা হিসেব করে দেখল—মুগলদের শাসনকালে হিন্দুরা ধর্মীয় প্রসঙ্গে কখনোই বিদ্রোহী হয়ে উঠেনি। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মের খোলসে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু মুগলশাসকরা হিন্দুদের শাসনকার্যে কাজে লাগিয়েছে। এজন্য উত্তম সরকারী কর্ম পাবার জন্য বহু হিন্দু ফার্সী শিখে নিয়েছে। বিপরীতক্রমে ভারতের মুসলমানগণ নিম্নবর্গ থেকে ধর্মান্তরিত বলে শাসনকার্যের উপযোগী শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। ফলে খাজনা আদায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে সকলপ্রকার শাসনকার্যে মুসলিম শাসকবর্গ হিন্দু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের কাজে লাগিয়েছে। আবার যখন ইংরেজরা মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে শাসনদণ্ড গ্রহণ করেছে তখন মুসলমানগণ শাসনক্ষমতা থেকে দূরে সরে গেছে—নিজস্ব ধর্মীয় খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
tagore-2.jpg
তারা শিক্ষিত-দক্ষ-অভিজ্ঞ-উচ্চাভিলাসী হিন্দু সম্প্রদায়কে কাজে লাগিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ও এক্ষেত্রে ইংরেজদের কাছ থেকে সকলপ্রকার শিক্ষা-চাকরীসহ বৈষয়িক সুবিধাদি আদায় করেছে। তারা হয়েছে বাবু শ্রেণী। মুসলমানদের চেয়ে হয়েছে অর্থবান। ফলে এই দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ভেদরেখা ছিল। তবে এই ভেদরেখাটি নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ছিল না। এই নিম্নবর্গের মানুষরা ছিল সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়া শ্রেণী। এমন কি নিম্নবর্গের হিন্দুরা উচ্চবর্গের হিন্দুদের কাছে ছিল দলিত—আর নিম্নবর্গের মুসলমানগণ উচ্চবর্গের মুসলমান বা আশরাফ শ্রেণীর কাছে ছিল আতরাফ বা নিচুজাত। তাহলে দেখা যাচ্ছে রেশারেশিটা ছিল উচ্চবর্গের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে।

সৈয়দ মুজতবা আলী এই উচ্চবর্গের বিভেদ বিষয়ে ‘বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি প্রবন্ধে’ লিখেছেন—”আজ যদি শুধুমাত্র সংস্কৃত পুস্তকপত্র থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হয় তাহলে এ দেশে মুসলমান ধর্ম আদৌ প্রবেশ করেছিল কিনা সে নিয়ে বিলক্ষণ তর্কের অবকাশ থাকবে। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, মুসলমান-আগমণের পর প্রচুর সংস্কৃত পুস্তক লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা পাননি সত্য, কিন্তু তাঁদের ব্রহ্মোত্তর দেবোত্তর জমিজমার উপর হস্তক্ষেপ না হওয়ার ফলে তাঁদের ঐতিহ্যগত বিদ্যাচর্চা বিশেষ মন্দীভূত হয়নি। কিন্তু এইসব পণ্ডিতগণ পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেই আপন আপন লেখনী সঞ্চালন করেছেন। …সেই ষঢ়দর্শননির্মাতা আর্য মণীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমণের পর সাত শত বৎসর ধরে যে আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু আলিসীনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রূশদ (লাতিনে আভেরস) ইত্যাদি মণীষীগনের দর্শনচর্চা হল তার কোনো সন্ধান পেলেন না।

এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো-আরিস্তোতলের দর্শনচর্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনি জানতেও পারলেন না যে, তিনি প্লাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তাঁর পাশের চতুষ্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি ‘গুলাত’ নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে খণ্ডণ করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই খণ্ডন করছেন। এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক-সুশ্রুতের আরবী অনুবাদে পুষ্ঠ বু আলী সিনার চিকিৎসাশাস্ত্র—‘য়ুনানী’ নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রীক ‘আইওনিয়ান=য়ুনানী’ চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর)-আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ানো হচ্ছে।”

এই হল বিভাজনচিহ্ণ। এই বিভাজন রেখাকে চতুর ইংরেজ ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। বুঝে নিয়েছিল এই বিভাজন রেখায় স্ফুলিঙ্গ দিলে আগুন জ্বলে উঠবে। দুপক্ষকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে।

ফলে সরকার সে সময় ডিভাইড এন্ড রুল নীতি করে। তারা ঠিক করে হিন্দু মুসলমানদের ব্যবহার করা হবে একে অন্যের বিরুদ্ধে। এ জন্যে শিক্ষা ও চাকরীর ক্ষেত্রে মুসলমানদের কিছু বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা আশা করে অচিরেই পূর্বে সুবিধাভোগী হিন্দুরা মুসলমানদের এই সুবিধাপ্রাপ্তিকে সন্দেহ করা শুরু করবে। এইভাবে বঙ্গে বিভেদের বিষবৃক্ষ রোপিত হল।

বঙ্গভঙ্গের প্রথম প্রতিবাদ
এলাহাবাদের দি পাইওনিয়ার পত্রিকায় মুদ্রিত প্রবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে দি বাঙ্গালী প্রথম প্রতিবাদমূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে ১০ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখে। এরপর ইন্ডিয়া গেজেটে রিজলের সম্পূর্ণ চিঠিটি প্রকাশিত হলে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। থ্রেটেন্ড পার্টিশন অব বেঙ্গল শিরোনামায় এই সময়ে প্রত্যহ দি বাঙ্গালী পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভার খবর ছাপা হতে থাকে।
অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদও ১৯০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্টার থিয়েটারে রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অধিবেশনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে প্রস্তাবটি বিরোধিতা করে। কার্জন স্বভাবতই এইসব চেঁচামেচিতে বিরক্ত বোধ করেছেন। ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভারতসচিব ব্রডরিককে লিখলেন, ‘বাঙালীরা নিজেদের একটা মহা জাতি মনে করে এবং তারা এমন একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন দেশ থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়েছে এবং জনৈক ‘বাবু’ কলকাতার লাট-প্রাসাদে অধিষ্ঠিত। এই সুখ-স্বপ্নের প্রতিকূল যে-কোনও ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই ভীষণভাবে অপছন্দ করবে। আমরা যদি দুর্বলতাবশত: তাদের হট্টগোলের কাছে নতি স্বীকার করি তবে কোনও দিনই আর বাংলার আয়তন হ্রাস বা বাংলা ব্যবচ্ছেদ সম্ভব হবে না। (এ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে) আপনি ভারতবর্ষের পূর্ব-সীমান্তে এমন একটা শক্তিকে সংহত ও সুদৃঢ় করবেন যা এখনই প্রচণ্ড, এবং ভবিষ্যতে যা সুনিশ্চিতভাবেই ক্রমবর্ধমান অশান্তির উৎস হয়ে উঠবে।

কার্জনরা ভারতে তাদের ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করতে একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আয়োজন করলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন– উনিশ শতকের জাগরণ, ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাসের উদার পাঠ এদেশের মানুষের চেতনার বন্ধ দরোজায় আঘাত হানছে। পুরনো অন্ধকারের মধ্যে হাজার সূর্যের আলো পড়তে শুরু করেছে। রাজনীতি কেবলমাত্র আর সামন্তশ্রেণীর মধ্যে আটকে থাকছে না। প্রজাসাধারণের মধ্যেও শাসনতান্ত্রিক অধিকারবোধটি জাগ্রত হয়ে উঠছে। তারা আর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না। আত্মশক্তির বোধটির জন্ম হচ্ছে।

বঙ্গভঙ্গের বিচ্ছেদ রঙ্গ
এরই অংশ হিসাবে কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে চলে গেলেন। তিনি ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহকে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দিলেন এবং নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করার মারাত্মক অস্ত্রে পরিণত করলেন। পাকিস্তানের বীজ রোপিত হল। এবং এক ধরনের হিন্দু নেতাদেরও হিংসার প্রবল বিষবৃক্ষ হিসাবে তৈরি করা হল। দেশের নতুন জাগ্রত চৈতন্যের মধ্যে পাপের জন্ম হল।
১৯০৪ সালের সীমানায় হস্তান্তরযোগ্য জেলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় রংপুর, বগুড়া ও পাবনা (৬ এপ্রিল), পাঁচমাস পরে (১৩ সেপ্টেম্বর) ভারত গভর্নমেন্ট রাজশাহী, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার হস্তান্তরের সুপারিশ করে। কিন্তু এগুলি হয়েছিল গোপনে, কার্জন তখন ভারতসচিব ও অন্যান্যদের মন থেকে দ্বিধার কাঁটা তুলে ফেলতে ব্যস্ত। ফলে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে জনসাধারণের বিক্ষোভও স্তিমিত হয়ে আসে। এটা ছিল কার্জনের একটি কৌশল।

কার্জনের শিক্ষা সংকোচন পদক্ষেপ
কিন্তু কার্জন অন্যভাবেও বিক্ষোভ জাগিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। দীর্ঘ নীরবতার পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সুপ্রীম কাউন্সিলে একটি বিল আনেন। বিলটি আনার আগে তিনি ১৯০২ সালে ২৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ কমিশন নিয়োগ করেন। কার্জনের ‘এফিসিয়েন্সি তত্ত্বের’ মাধ্যমে শিক্ষা সংকোচনের নীতির প্রস্তাব রিপোর্টে করা হয়। সিনেটে সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ইংরেজ সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, বেসরকারী কলেজে আইন-পড়ানো বন্ধ করা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজগুলির অবলুপ্তি, শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে পাশ মার্ক ও বেতন বৃদ্ধি, সিন্ডিকেটের হাতে স্কুল-কলেজের স্বীকৃতিদান বা এফিলিয়েশন ও প্রত্যাহারের অপার ক্ষমতাদান প্রভৃতি সুপারিশও কার্জনের রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়।। কমিশনের অন্যতম সদস্য ডঃ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই রিপোর্টের সঙ্গে দ্বিমত ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র প্রতিবাদী মন্তব্য পেশ করেন। আগস্টের গোড়ায় এই রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়।

রবীন্দ্রনাথের নীরবতা
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে নেই। কোনো সভাতে অংশ নিতে তাঁকে দেখা যায় না। তিনি কোনো ব্ক্তৃতাও করছেন না। কোনো প্রবন্ধও লিখছেন না। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই এই আন্দোলনে আছেন। এমন কি শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ নীরবতা পালন করছেন। অথচ এর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। এই নীরবতায় অনেককে আশ্চর্য করে।

এই সময়ে তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। ছোটো গল্প লিখছেন। ঈশ্বর ও দেশ নিয়ে নৈবেদ্যের কবিতাগুলি লিখছেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা ওরফে বেলার বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে। শান্তি নিকেতনের বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। এবং তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন ২৩ নভেম্বর ১৯০২ সালে। লিখছেন নৌকাডুবি উপন্যাস। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর লেখালেখি চলছে।

রবীন্দ্রনাথ নীরবতা ভাঙলেন
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মজফ্ফরপুরে। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোণামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও য়ুনিভার্সিটি বিল দুটি বিষয়েই তার নিজস্ব মত প্রকাশ করলেন। কার্জন কিছুদিন নীরব থাকলেন এবং প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে আন্দোলনকারীরাও নিরব হয়ে গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ সরব হলেন। এই নিরবতার সময়টিকেই কবি কথা বলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, আন্দোলন যখন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছিল আমরা তখন কোনো কথা বলি নাই; এখন বলিবার সময় আসিয়াছে।

তিনি এই দীর্ঘ আন্দোলন-মুখর সময়ে দূরে থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ছেন। নিজের লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তিনি বললেন, এই বঙ্গবিচ্ছেদ আন্দোলন অপূর্ব। অর্থাৎ এ ধরনের আন্দোলন এ দেশে পূর্বে হয় নি। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দেশে রাজনৈতিক উত্থান পর্বের সুচনা হয়েছে। দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে রাজশক্তির তীব্র আঘাতে।

প্রচলিত রাজনীতির সমালোচনা
এর আগে কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলো ইংরেজ রাজশক্তির আশ্রয়ে থেকেই কথা বলেছে। তাদের নেতৃত্বে আছে ভূস্বামী বা জমিদার, উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সিংহভাগ নিম্নবিত্তকে তারা কখনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে নি। তারা ইংরেজদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেই পছন্দ করেছে। তাদের শ্রেণীর কিছু চাওয়া-পাওয়া নিয়ে রাজশক্তির কাছে দেনদরবার করেছে—আবেদন নিবেদন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এটা ছিল এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি। দেশের মানুষের যে রাষ্ট্রশক্তির কাছে আবেদন নিবেদন নয়—অধিকার আছে, সে অধিকার দাবী করারও শক্তি আছে—সেটা তারা কখনো মনে করে নি।

তারা যেটা করেছে সেটা হল একধরনের বক্তৃতাবাজি। এই বক্তৃতাগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল নানা কায়দায় ইংরেজতোষণ। তাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার আকুতি। আর প্রাপ্ত সুবিধাদির জন্য কৃতজ্ঞতাবাচক শব্দজঞ্জাল সৃষ্টি করেছেন।এটুকু করেই তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। নিজেরা যে কিছু করতে পারেন সে ধরনের আত্মশক্তি এইসব নেতাদের ছিল না– ছিল না কোনো মনোবল-ব্যক্তিত্ব বা পরিকল্পনা । যখন তারা কখনো রাজশক্তির কাছে কোনো আবেদন নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন রাজভক্তির ভড়ং। ‘সামলাইয়া কথা কহিবার প্রয়াস’।

তারা কখনো ‘মনের কথা স্পষ্ট করিয়া কহিবার চেষ্টাই’ করে নি। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এরা রাজনৈতিক সভাস্থলে দুই কূল রক্ষা বাঁচাইয়া কথা কহিবার চেষ্টা করিয়াছে। রাজশক্তির অজস্র গৌরচন্দ্রিকার দ্বারা তারা সর্বপ্রথমেই ‘গোরার’ মনোহরণব্যাপার সমাধা করিয়া তাহার পরে ‘কালার’ তরফের কথা তুলিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ এই মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে হতভাগ্য ও হতবল বলে কঠোর ভাষায় ধিক্কার দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাদের এতকালের কর্মকাণ্ড সবই নিষ্ফল এবং উপহাসযোগ্য।
এই আন্দোলনের ইতিবাচক দিক
চলমান এই আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন– এবারই প্রথম রাজনীতিকরা দুটো বিষয়কে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন–
১. বিশ্ববিদ্যালয় বিলের মাধ্যমে ইংরেজরা এদেশের উচ্চশিক্ষা, স্বাধীন শিক্ষার মূলোচ্ছেদ করতে চায়।
২. বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালিজাতিকে দুর্বল করতে চায়।
শিক্ষা ও ঐক্য—এ দুটো বিষয়ই জাতিমাত্রেরই আত্মোন্নতি ও আত্মরক্ষার চরমসম্বল। এ দুটোর উপর আঘাত পড়ায় দেশের মানুষ নড়ে চড়ে উঠেছে। নিজেদের মুখে নিজেদের কথা বলার একটা সুযোগ ঘটেছে। এই প্রথম রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস জন্মেছে। এটা অভূতপূর্ব।

রবীন্দ্রনাথ এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বিস্ময়কর রকমভাবে রাজনীতিকদের চরিত্র বিষয়ে একটি সত্যপ্রকাশ করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন—রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস করা শুরু করলেও রাজশক্তির প্রতি বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করা যায়নি। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রপথে সকল অর্জনই বেরিয়ে পড়ছে—ধরে রাখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ছিদ্রটি হল দেশের নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে এই রাজনীতিকদের কোনো সম্পর্কই নেই। মুষ্টিমেয় জমিদার, উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেই অন্ধের মত চলছে। ফলে দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের সংযোগ নেই।

স্বদেশপ্রেম : নতুন অর্জন
কিন্তু এই অপূর্ব আন্দোলনটিকে স্বাগত জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মনে করেন, পরের কাছ থেকে সুস্পষ্ট আঘাত পেয়ে পরতন্ত্রতা শিথিল হলে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে উঠবে। ‘আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা আমাদের কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।

এই দেশ প্রেম একটা শক্তি, তার নাম দেশ প্রেম। এই শক্তি যখন হৃদয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা পরিণত হয় এক মহাশক্তিতে। এই মহাশক্তি দিয়ে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াই করা যায়–সেই লড়াইটারই সূচনাপর্ব রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন। এর আগে বাংলায় এই দেশপ্রেমের উন্মেষ রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ এভাবে দর্শন করতে পারেন নি।
১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।

শিক্ষা বিষয়ে ভাবনা
কার্জনের শিক্ষা সংকোচন বিল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, বিলিতি য়ুনিভার্সিটির ব্যয়বহুল আয়োজন দেশীয় জীবনযাত্রার জন্য সংগতিপূর্ণ নয়, ‘আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল—দেশের উচ্চনিচ্চ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্রণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। কিন্তু বিলিতি আদর্শে শিক্ষা যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অত্যন্ত বৃহৎ হয়ে উঠবে।
অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে ছাত্র ও অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যবধান নেই, তাই শিক্ষাদানের উন্মুখতা ও বিদ্যালাভের জন্য প্রস্তুতি মানসিক সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়। তিনি এক্ষেত্রে বিদেশী শিক্ষা অধিকর্তা পেডলারের সঙ্গে সেই মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করা অতি দুরুহ ও অনিষ্টকর বলে ঘোষণা করেন, ‘হৃদয়ে হৃদয়ে যেখানে স্পর্শ নাই, যেখানে সুস্পষ্ট বিরোধ ও বিদ্বেষ আছে, সেখানে দৈববিড়ম্বনায় যদি দানপ্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তবে সে-সম্বন্ধ হইতে শুধু নিষ্পলতা নহে, কুফলতা প্রত্যাশা যায়। জাপানের মতো সুযোগ ও আনুকূল্য পেলে সহজেই ভারতীয়রা সেই শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লাচন্দ্রের সাধনা ও সাফল্য উল্লেখ করেন।

সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেছেন, এ স্থলে আমাদের একমাত্র কর্তব্য, নিজেরা সচেষ্ট হওয়া, আমাদের দেশে ডাক্তার জগদীশ বসু প্রভৃতির মতো যে-সকল প্রতিভাসম্পন্ন মনস্বী প্রতিকূলতার মধ্যে থাকিয়াও মাথা তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগকে মুক্তি দিয়া তাঁহাদের হস্তে দেশের ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার স্বাধীন অবকাশ দেওয়া; অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা-অনাদরের হাত হইতে বিদ্যাকে উদ্ধার করিয়া দেবী সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা করা; জ্ঞানশিক্ষাকে স্বদেশের জিনিস করিয়া দাঁড় করানো; আমাদের শক্তির সহিত, সাধনার সহিত, প্রকৃতির সহিত তাহাকে অন্তরঙ্গরূপে সংযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বভাবের নিয়মে পালন করিয়া তোলা।‘

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনা
বঙ্গভঙ্গ, য়ুনিভার্সিটি বিল ও দেশের কথা এই তিনটি সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্য ও আত্মশক্তির কথা বলেছিলেন। তাকেই তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকারে হাজির করলেন স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে।
তিনি প্রথমেই ঘোষণা করেন, আমাদের যে-সকল অভাব বিদেশীরা গড়িয়াছে ও তুলিতেছে, সেগুলো না হয় বিদেশী পূরণ করুক। …আমাদের দেশে সরকার বাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে-কোনো বিষয়ে তাঁহার কাছ হইতে প্রত্যাশা করিব, তাহা স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে। যে-কর্ম সমাজ সরকারের দ্বারা করাইয়া লইবে, সেই কর্মসম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিয়া তুলিবে। অথচ এই অকর্মণ্যতা আমাদের দেশের স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। আমরা নানা জাতির, নানা রাজার আধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্রবৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের কাহাকেই হস্তক্ষেপ করিতে দেয় নাই। সেইজন্য রাজ্যশ্রী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় গ্রহণ করেন নাই।

এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন বাঙালির চিত্ত ঘরমুখ নিয়েছে। স্বদেশের শাস্ত্র, স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়ে উঠছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হল—স্বদেশের শিল্পদ্রব্য নিজেদের কাছে আদর পাচ্ছে, স্বদেশের ইতিহাস বাংলার গবেষণাবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলছে।

এ সময় রাজনৈতিক সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে ধারণ করাই সকলের কর্তব্য। সে হৃদয়কে ধারণ করার জন্য করণীয় তিনি নির্ধারণ করেছেন–
১. কৃষিমেলার আয়োজন
তিনি বিলেতি ধরনের সভার বদলে দেশী ধরনের মেলা করার প্রস্তাব করেন। সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্ত হতে একত্র হবে। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হবে। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদেরকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশসুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের যা কিছু বলার কথা আছে, যা-কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলে সহজ বাংলা ভাষায় করতে হবে।
২. হিন্দু-মুসলমান মিলন
প্রত্যেক জেলার ভদ্র শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহাদের জেলার মেলাগুলিকে যদি নবভাবে জাগ্রত, নবপ্রাণে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন, ইহার মধ্যে দেশের শিক্ষিতগণ যদি তাহাদের হৃদয় সঞ্চার করিয়া দেন, এই-সকল মেলায় যদি তাহারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করেন—কোনোপ্রকার নিষ্ফল পলিটিক্সের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি প্রভৃতি সম্বন্ধে জেলার যে-সমস্ত অভাব আছে, তাহার প্রতিকারের পরামর্শ করেন, তবে অতি অল্পকালের মধ্যে স্বদেশকে যথার্থই সচেষ্ট করিয়া তুলিতে পারেন।
৩.ধর্মীয় দূষিত মেলা সংস্কার
কবি দেখেছেন আমাদের দেশে যে-সকল মেলা ধর্মের নামে প্রচলিত আছে—সেগুলোর অধিকাংশই লোকশিক্ষার অযোগ্য হয়ে উঠে হয়েছে—কুশিক্ষারও মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তিনি এইসব কুৎসিত আমোদের উপলক্ষ এই ধর্মীয় মেলাগুলোকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। তার বদলে দেশী মেলার আয়োজন করতে হবে।
৪. নতুন ধরনের নেতৃত্ত্ব সন্ধান : জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের রূপরেখা
স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে উপলদ্ধির কথা বলেন। শর্করারস যেমন একটি সূত্রকে অবলম্বন করে মিছরির দানায় পরিণত হয়, তেমনি সমাজের বিচ্ছিন্ন শক্তি ও কর্মপ্রয়াসকে সংহত করার জন্য তিনি একজন সমাজপতি মনোনয়নের কথা বলছেন। তিনি বলেন, এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।
এজন্য একজন সমাজপতি দরকার। তার সঙ্গে তার পার্ষদসভা থাকবে। তারা সবাই মিলে সমাজের সমস্যা, সমাজের মানুষের জন্য করণীয়-কর্তব্য নিরূপণ করবে। সেখানে সকলে আলোচনা করবেন। লোকসাধারণ প্রাণ খুলে তাদের কথা বলতে পারবেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গৃহীত হবে এবং সেগুলো সমাজপতির নেতৃত্ত্বে বাস্তবায়ন করা হবে। এইভাবে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এটাকে একটি স্বাধীন জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ়—তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত অধিকার করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে। এখান সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে হইলে অত্যন্ত নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাঁড় করাইতে হইবে।

এই স্থানীয় সরকার বা সমাজের প্রধান সমাজপতি কখনো ভালো, কখনো মন্দ হইতে পারেন, কিন্তু সমাজ যদি জাগ্রত থাকে, তবে মোটের উপরে কোনো ব্যক্তি সমাজের স্থায়ী অনিষ্ট করিতে পারে না। তার নেতৃত্বেই সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এর অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হবেন। সমাজের সমস্ত অভাবমোচন, মঙ্গলকর্মচালনা ও ব্যবস্থারক্ষা এঁরা করবেন এবং সমাজপতির নিকট দায়ী থাকবেন। তিনি বিশেষভাবে বলেন, আমাদের দেশে মধ্যে মধ্যে সামান্য উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমানে যে বিরোধ বেধে ওঠে, সেই বিরোধ মিটিয়ে দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রীতিশান্তিস্থাপন, উভয় পক্ষের স্ব স্ব অধিকার নিয়মিত করে দেবার বিশেষ কর্তৃত্ব সমাজপতির নেতৃত্বে থাকবে।

সমাজপতির হওয়ার মতো এমন লোক পাওয়া কঠিন। একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়ে তোলা না করা গেলে এই সমাজপতি নির্বাচন করা কঠিন। এ সমস্ত সমস্যা থাকা সত্বেও তিনি লিখেছেন, যদি সমাজপতি-নিয়োগের প্রস্তাব সময়োচিত হয়, যদি রাজা সমাজের অন্তর্গত হওয়াতে সমাজ অধিনায়কের যথার্থ অভাব ঘটিয়া থাকে, যদি পরজাতির সংঘর্ষে আমরা প্রত্যহ অধিকারচ্যূত হইতেছি বলিয়া সমাজ নিজেকে বাঁধিয়া তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্য ইচ্ছুক হয়, তবে কোনো একটি যোগ্য লোককে দাঁড় করাইয়া তাঁহার অধীনে এক দল লোক যথার্থভাবে কাজে প্রবৃত্ত হইলে এই সমাজ-রাজতন্ত্র দেখিতে দেখিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিবে—পূর্ব হইতে হিসাব করিয়া কল্পনা করিয়া আমরা যাহা আশা করিতে না পারিব, তাহাও লাভ করিব—সমাজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি এই ব্যাপারের চালনাভার আপনিই গ্রহণ করিবে।

রবীন্দ্রনাথের তৎপরতা
এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুরে। কলকাতায় ফিরেই তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে পড়ে শোনালেন। অন্য কিছু ব্যক্তিকেও তাঁর স্বদেশভাবনা বিষয়ক পরিকল্পনার কথা জানালেন। চৈতন্য লাইব্রেরী এন্ড বীডন স্কোয়ার লিটারেরি ক্লাবের উৎসাহী সম্পাদক গৌরহরি সেন ২২ জুলাই ১৯০৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠের ব্যবস্থা করেন।
প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে জানাচ্ছেন যে, চৈতন্য লাইব্রেরীর এই প্রবন্ধপাঠের বিষয়বস্তু মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার জন ছাত্র ও জনসাধারণ সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে সভাস্থলে ও সভার বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়—কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে মারামারি ও ইঁটপাটকেল ছোঁড়া কিছুই বাদ যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে বলে উপসংহারে প্রবন্ধ-লেখক স্বদেশের পূজার জন্য সকলকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায় আহ্বান করেছিলেন। কলকাতা শহরের অনেক গণ্যমান্য লোক কবির এই প্রবন্ধপাঠ শুনে চিত্রার্পিতের ন্যায় নীরবে শুনেছিলেন।

যারা প্রবন্ধটি শুনতে পারেননি তাদের অনুরোধে মিনার্ভা হলে কবি আবার প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে ৩০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি ২০০০ কপি ছেপে বিতরণ করা হয়েছিল পাঠের আগে। প্রবন্ধটিতে কিছু বক্তব্য সংযোজন করেছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথের গায়ে জ্বর ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। একটি চেয়ারে বসে প্রবন্ধটি পাঠ করেন।

রাজনীতিতে বাঁক পরিবর্তনের লক্ষণ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে রাজনীতি আর পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। রাজনীতির একটি নূতন বাক পরিবর্তন ঘটছে। তিনি বলেন, দেশ যখন একদা জাগ্রত হইয়া ‘কনষ্টিটিউশনাল অ্যাজিটেশনে’র রেখা ধরিয়া রাজ্যেশ্বরের দ্বারের মুখে ছুটিয়াছিল, তখন সমস্ত শিক্ষিত সমাজের বুদ্ধিবেগ তাহার মধ্যে ছিল। আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে সেই স্রোতের পথ বাঁক লইবার উপক্রম করিতেছে।…যাঁহারা সাধনাদ্বারা, তপস্যাদ্বারা, ধীশক্তিদ্বারা ইংরেজশিক্ষিত সমাজের চিত্তকে স্বদেশের কার্যে চালিত করিয়াছেন, স্বদেশের কার্যে একাগ্র করিবার আয়োজন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে আমি ভক্তির সহিত নমস্কার করি। তাঁহারা যে পথে গিয়াছিলেন সে পথে যাত্রা যে ব্যর্থ হইয়াছে, এ আমি কখনোই বলিব না। তখন সমস্ত দেশের ঐক্যের মুখ রাজদ্বারেই ছিল।

…এখন সে চিরন্তন সমুদ্রের আহ্বান শুনিয়াছে—এখন সে আত্মশক্তি আত্মচেষ্টার পথে সার্থকতালাভের দিকে অনিবার্যবেগে চলিবে, কোনো-একটা বিশেষ মুষ্টিভিক্ষা বা প্রাসাদলাভের দিকে নহে। এই-যে পথের দিক-পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিতেছে ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের কৃতকর্ম নহে—যে চিত্তস্রোত প্রথমে এক দিকে পথ লইয়াছিল ইহা তাহারই কাজ, ইহা

No comments:

Post a Comment