সাম্যের গান গাই আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই "
একজন মানুষ হিসেবে নজরুল জন্মালেন ,এবং মারা ও গেলেন ।কিন্তু জন্ম মৃত্যুর মাঝে নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে আমাদের মাঝে অমর হয়ে রইলেন
"সেইজন্য একজন কাজী নজরুল ইসলাম একজন কাজী নজরুল ইসলাম ই । "
মানবতার কবি , মানুষের কবি তার সাহিত্যর বজ্র বিদ্যুৎ নিয়ে উড়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশ জুড়ে বসলেন ।
কবির সৃজনশীল জীবনের সময়সীমা স্বল্পকালীন হলেও অনেক বেশি বিচিত্র , তাঁর ব্যাক্তি জীবন ও কর্মজীবন এর বেলায়
ও আমরা সেটাই দেখি ।
একাধারে সাম্যের কবি , মানবতার , প্রেমের ,দ্রোহের বিদ্রোহের কবি তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।
বাংলার ,বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী একজন মানুষের মানবিক সত্ত্বা কেমন হতে পারে ,তা নজরুল আমাদের দেখিয়েছেন
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবন ও সাহিত্যর ছবি সহ কাল নির্দেশিকা ।
১৮৯৯- - - ২৪শে মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) বুধবার কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্ম।
বর্ধমান জেলার আসানসোল মুহকুমার তৎকালীন রাণীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামের ঐতিহ্যমণ্ডিত কাজী পরিবারের এই কুটিরে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ।
১৯০৮--- ২০শে মার্চ নজরুল এর পিতা কাজী ফকির আহমেদ এর মৃত্যু ।
কিশোর নজরুল ।
১৯১০- - -আর্থিক অভাবে শিক্ষা জীবন বিঘ্নিত - মসজিদের ইমামতি ,মাজারের খাদেমগিরি ইত্যাদি কাজে জীবিকা নির্বাহ ।
১৯১১-১৯১২-- শিয়ারসোল রাজ হাই স্কুলে ভর্তি ও ঐ স্কুল ত্যাগ মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনিস্টিটিউশনে ভর্তি ,দুই বৎসর পাঠ গ্রহন ,কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক্ কে শিক্ষক রুপে লাভ ।
শিয়ারসোল রাজহাই স্কুল এ সামান্য কিছু দিন পড়াশুনা করেছিলেন ।
১৯১৩-- -আসানসোলে রুটির দোকানে চাকরী
পুলিশ ইনিস্পেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ্র সাথে পরিচয় ।
আসানসোল এর সেই রুটির দোকান ।
রফিজউল্লাহ দারোগার পত্নী শামসুন্ননেসা খানম ।
১৯১৪--- ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুল এ ৭ম শ্রেণীতে অধ্যায়ন ।
১৯১৭-- - ৪৯ নং বাঙালী পল্টন এ যোগদান ।
১৯১৯ --- লেখক রুপে নজরুল এর আত্ম প্রকাশ " বাউন্ডেলের আত্ম কাহিনী " ১৩২৬ এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা মাসিক "সাওগাত"
এই বছরে প্রথম কবিতা " মুক্তি " প্রকাশ , বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা ,শ্রাবন (১৩২৬) সংখ্যা । নজরুল তখন করাচি সেনা বাহিনী তে কর্মরত ।
১৯২০ --- করাচি থেকে কলকাতায় আগমন , বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজাফফর আহমেদ এর সংগে বসবাস শুরু । এপ্রিল (বৈশাখ ১৩২৭) থেকে " মোসলেম ভারত" পত্রিকায় " বাঁধনহারা " উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ শুরু, জুলাই থেকে মুজাফফর আহমেদ সংগে নজরুল " দৈনিক নবযুগ "পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত ।
মুজাফফর আহমেদ এর সংগে নজরুল ।
১৯২১--- আলী আকবর খান এর সংগে কুমিল্লা গমন ।সৈয়দা খাতুন এর সাথে প্রনয় বিবাহ ১৮ জুন (৩রা আষাঢ় ,১৩২৩) সৈয়দা খাতুনের নজরুল এর দেয়া নাম " নার্গিস " ।
নার্গিস পরিবার এর সাথে কোন বিষয় এ নজরুল এর বিরোধ এবং ৪ঠা আষাঢ় ভোরে নজরুল এর দৌলতপুর ত্যাগ ,অক্টোবর এ ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লার সাথে নজরুল এর শান্তিনিকেতনে গমন ও রবীন্দ্রনাথ এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ , ডিসেম্বর এর শেষ সপ্তাহে " বিদ্রোহী " রচনা ।
নার্গিস পরিণত বয়সে
১৯২২-- ৬ই জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী তে " বিদ্রোহী " প্রকাশ
এখানে বিদ্রোহী রচনা করেছিলেন ।
১৩২৬ এর কার্তিক সংখ্যা ।" মোসলেম ভারত " এ একই সাথে । মার্চ এ প্রথম ক্যাব গ্রন্থ " ব্যাথার দান প্রকাশ ।
২৬ শে সেপ্টেম্বর " ধুমকেতু " তে কবির আনন্দময়ীর আগমনে এবং ১৩ অক্টবার ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী প্রকাশ ।
২৫ অক্টবার অগ্নিবীণা প্রকাশিত।
৮ই নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুল এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী
২৩শে নভেম্বার কুমিল্লায় নজরুল গ্রেফতার ।
১৯২৩--- ৭ই জানুয়ারী " রাজবন্দীর জবানবন্দী " রচনা
১৬ জানুয়ারী নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত
২২ শে ফেব্রুয়ারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর গীতিনাট্য " বসন্ত" নজরুল এর নামে উৎসর্গিত ।
এপ্রিলে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর জুলুম এর প্রতিবাদ এ নজরুল এর অনশন ৩৯দিন অনশন ভঙ্গ ।
ডিসেম্বর এ নজরুল এর মুক্তিলাভ ।
১৯২৪ --- সালে আশালতা সেন গুপ্তা র সাথে বিবাহ বন্ধনে এবং হুগলীতে ঘর সংসার শুরু ।
প্রমীলা নজরুল এর বিয়ের বেনারসি।
প্রথম পুত্র আজাদ কামালেরজন্ম ও আকিকা উৎসব ।কিছুদিন পর এই সন্তান এর মৃত্যু ।
বিষের বাঁশি ও "ভাঙ্গার গান " প্রকাশিত। এবং ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা ।
১৯২৫--- ফরিদপুর কংগ্রেস এ গান্ধী জির সাথে সাক্ষাৎ ।
চিত্তরঞ্জন এর মৃত্যু তে অর্ঘ্য চিত্তনামা প্রকাশ ।
১০ই নভেম্বর ' The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress " গঠিত হয় । ঐ পার্টির ইস্তেহার নজরুল ঘোষিত ও প্রকাশিত । লাঙল পত্রিকা প্রকাশ এবং সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত ।
১৯২৬--- কৃষ্ণ নগরে বসবাস শুরু , কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পরজয়। সেপ্টেম্বার এ কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল (অরিন্দম খালেদ) এর জন্ম।
কৃষ্ণ নগর কটেজ এর সামনে , নজরুল এর কোলে বুলবুল , সেবিকা , শ্বাশুরি গিরিবালা দেবী এবং প্রমীলা ।
প্রথম গজল রচনা ।বাগিচায় বুলবুলি তুই দিসনে আজি দোল ।
প্রমিলার র কোলে বুলবুল ।
১৯২৭--- মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশন এ যোগদান ও ভাষণ প্রদান ।এই বছর ই আবুল কালাম সামসুদ্দীন এর নজরুলকে যুগ প্রবর্তক কবি " বলে অভিহিত করন। ডিসেম্বার এ " বড়র পিরীতি বালির বাধ" প্রবন্ধ প্রকাশ ।
১৯২৮--- সাওগাত পত্রিকায় ইব্রাহিম খাঁ র পত্রের উত্তরে নজরুল এর বক্তব্য প্রকাশ ।
ফজিলাতুন্নেসা র সাথে প্রথম পরিচয় ও অনুরাগ ।শরৎ চন্দ্রের সংবর্ধনায় নজরুল এর গান রচনা ।সাওগাত এ "নজরুল ই স্থান" কলম প্রবর্তিত ।
এই বিদুষী মহিলার সাথে পরিচয় হবার পর ,উনার জন্য নজরুল গান লিখেন ।
১৯২৯-- - ৯ই অক্টোবর তৃতীয় পুত্র সব্যসাচীর জন্ম ।১৫ ই ডিসেম্বর ,জাতীর পক্ষ হতে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন ।
১৯৩০--- পুত্র বুলবুল এর মৃত্যু , প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দু সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ ।
পুত্র বুলবুল
১৯৩১--- ম্যাডান থিয়েটার এর সুর ভাণ্ডারী নিযুক্ত
১৯শে ডিসেম্বর কলকাতার রঙ্গমঞ্চে " আলেয়া ' প্রদর্শিত ।
২৪শে ডিসেম্বরকনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধের জন্ম।
পুত্র সানি ও নিনি , সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ ।
পুত্র কে লেখা কবির চিঠি
১৯৩২--- আগস্টে স্বদেশী মেগাফোন কোম্পানি র সাথে যুক্ত।
পূজার গান রিলিজ অনুষ্ঠানে " মনে পরে আজ কোন জনমে "
১৯৩৩ --- ধ্রুব চলচিত্রের জন্য গান রচনা , এবং নারদ এর ভুমিকায় অভিনয় ।
প্রতিভা বসু র সাথে গান নিয়ে আলাপ।
১৯৩৩--- ধ্রুব চলচিত্রর মুক্তি।
১৯৩৬--- ফরিদপুর এ মুসলিম ছত্র পরিষদ এর সম্মেলন এ সভাপতিত্ব এবং অভিভাষণ দান ।
১৯৩৮---- কলকাতা বেতার এ " হারামনি , নবরাগ , মালিকা ,এই অনুষ্ঠান সমূহ নজরুল পরিচালিত।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলন এ যোগদান । প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ।
১৯৩৯--- সাপুড়ে ছায়াচিত্রের কাহিনী ও গান রচনা।
১৯৪১--- যতীন্দ্র মোহন বাগচির সভাপতিত্তে কলকাতায় মহাসমারোহে জন্মদিবস উদযাপিত।
৭ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথ এর মৃত্যুর পরপরই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে " রবিহারা ' নামে কবিতা আবৃত্তি ।
নবযুগ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহন।
১৯৪২--- সাল এর ১০ই জুলাই কবি অসুস্থ হয়ে পরেন।
৭ই অক্টোবর কলকাতার লুম্বিনি পার্ক হসপিটাল এ চিকিৎসা ব্যর্থ ।
সেই সময় কবির কিছু লেখা ।
১৯৪৫--- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালইয়ের জাগত্তরিনী স্বর্ণ পদক
জাগোত্তরোণী স্বর্ণ পদক।
১৯৫২--- রাঁচি তে প্রেরন ।
নজরুল এর গাড়ী রাঁচির বাড়ির সামনে।
১৯৫৩--- কবিকে লন্ডন প্রেরন
কবির পাস পোর্ট
লন্ডনে সারে তে চিকিৎসা রত নজরুল।
১৯৬০--- ভারত সরকারের " পদ্মভূষণ" প্রদান ।
পদ্ম ভূষণ পদক ।
১৯৬২--- প্রমীলার মৃত্যু ।
দুই ভাত্র বধূর সাথে নজরুল ।
১৯৬৭---- রাশিয়ান ভাষায় অনুদিত নজরুল রচনা প্রকাশ।
১৯৭২---- স্বাধীন বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাস্ট গঠন এর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান ভারত সফরে কলকাতায় এসে ভারত সরকারের কাছে আবেদন রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মদিন পালন করার, ২৪ শে মে বাংলাদশ এ আনীত।
ঢাকায় আসবার পূর্বে আব্বাস উদ্দিন এর চিঠি প্রমীলা নজরুল কে
বিমানে আগমন।
বিমানবন্দরে মানুষের ঢল
২৫শে মে ৭৩ তম জন্মজয়ন্তী পালিত হয়
ফিরোজা বেগম গান শোনাচ্ছেন কবি কে
ঢাকায় কবিকে দেখতে এসেছেন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পত্নী ।
১৯৭৫--- কবিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের ডি-লিট উপাধি প্রদান
পেনশন চেক প্রদান
১৯৭৫--- কবিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের ডি-লিট উপাধি প্রদান।
১৯৭৬---- সালে জানুয়ারী মাসে কবিকে বাংলাদেশে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন ।২১ ফেব্রুয়ারিতে ২১ শে পদকে ভূষিত করা হয়।
মৃত্যুর ৭ দিন পূর্বে নজরুল ।
২৪শে মে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রাহমান কবি নজরুল কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মি ক্রেস্ট উপহার দেন ,এবং নজরুল এর চল চল চল সঙ্গীত টিকে বাংলাদেশের রন সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করেন।
২৯শে আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন
অন্তিম শয়নে নজরুল ।।
মোনাজাত করছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রাহমান ।
কবির গানের ভাষায় বলে যাওয়া ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবি কে সমাহিত করা হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল এবং মকবুল ফিদা হুসাইন এর তুলিতে নজরুল।
কবির কিছু ব্যাক্তিগত জিনিস
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা ।
কবির কুরআন শরীফ ।
সাম্যবাদ এর কবি
শিখ ধর্মীয় নেতাদের সাথে কবি ।
লেখায় মগ্ন কবি ।
২০০৯ সালে প্রকাশিত কবির ফ্যামিলি ট্রি ।
কল্যাণীর ভাষায় নজরুল এর শারীরিক উপস্থিতি ছিল বাংলাভাষী দের কাছে প্রেরণার উৎস ।তার চলে যাওয়া দুই বাংলা শোকের সাগরে ভেসেছিল ।কেননা তিনি ছিলেন আমাদের চেতনা তে ছিলেন আমাদের প্রানের কবি ।
তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন উত্তরন এর পথ যতই কঠিন হোক না কেন , চেস্টা , সাধনা আর প্রতিভায় জীবনের চরাই উৎরাই পেরিয়ে ঠিক আসাধারন হয়ে উঠা সম্ভব ।Collected
কাজী নজরুল ইসলাম (উচ্চারণ: [Kazi Nazrul Islam], মে ২৫, ১৮৯৯–আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬–ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অগ্রণী বাঙালি
কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে
অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য।[১] বাঙালী মণীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন নজরুল। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি
নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর
মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং
সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার।
তাঁর
কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে[২] আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল)[৪] দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ।[১] একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবিকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গিত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন - “ কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। ”
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: "আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ", এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা
শিখেন। এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে
সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক- এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?"
শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়
এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে
তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে
মুজফ্ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে
রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন
ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও
তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে: হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী- সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন"। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের
সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর
বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে
পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।
তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[৫]
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরন করেন। যেমনঃ কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।[৬]
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই
অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি
হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি
এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন
উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা
হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের
শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে
নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি, এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন। কবি চার মাস রাঁচিতে ছিলেন।
এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন: রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক- তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন। প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল ছিল অসম্ভব। একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল "ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস" রোগে ভুগছেন। এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফি নামক এক্স-রে করানো হয়। এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে। ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানে হয়েছিল। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন। ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় (সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি)- কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফের অধীনে ভর্তি করানো হয়। এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি- তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন। নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।[৭]
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই";- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।
তাঁর জানাজার নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান।[৮] বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন- অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতারণ। আর খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা, কারণ এই সমন্বিত সুলতানী শাসন ব্যবস্থার প্রধান তথা তুরস্কের সুলতানকে প্রায় সকল মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের খলীফা জ্ঞান করতো। নজরুল এই দুটি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা তথা স্বরাজ অর্জনে বিশ্বাস করতেন যা মহাত্মা গান্ধীর দর্শনের বিপরীত ছিল। আবার মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন তুরস্ক গড়ে তোলার আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল। তারপরও তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন যোগ দিয়েছিলেন। এর কারণ, এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
তবে সব দিক বিচারে নজরুল তার রাষ্ট্রীয় ধ্যান ধারণায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন কামাল পাশার দ্বারা। নজরুল ভেবেছিলেন তুরস্কের মুসলমানরা তাদের দেশে যা করতে পেরেছে ভারতীয় উপমহাদেশে কেন তা সম্ভব হবেনা? গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর। আর তার এই অবস্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল কামাল পাশার। সে হিসেবে তার জীবনের নায়ক ছিলেন কামাল পাশা। নজরুলও তার বিদ্রোহী জীবনে অনুরুপ ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯২১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমদ ও নজরুল তালতলা লেনের যে বাসায় ছিলেন সে বাড়িতেই ভারতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল। ১৯১৭ সনের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেও নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনই এই দলের সদস্য হননি, যদিও কমরেড মুজফ্ফর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আজীবন।
১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণের চেষ্টা করেন। প্রথমে কংগ্রেসে সমর্থন লাভের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু কংগ্রেসের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে তিনি তেমন সাফল্য পাননি। এরপর সাহিত্যের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বহিপ্রকাশ অব্যাহত থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়। [৯]
Link: https://en.wikipedia.org/wiki/Kazi_Nazrul_Islam
Link For English
Link For Bengali
My Facebook ID's Link:https://web.facebook.com/jrliton77
"সেইজন্য একজন কাজী নজরুল ইসলাম একজন কাজী নজরুল ইসলাম ই । "
মানবতার কবি , মানুষের কবি তার সাহিত্যর বজ্র বিদ্যুৎ নিয়ে উড়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশ জুড়ে বসলেন ।
কবির সৃজনশীল জীবনের সময়সীমা স্বল্পকালীন হলেও অনেক বেশি বিচিত্র , তাঁর ব্যাক্তি জীবন ও কর্মজীবন এর বেলায়
ও আমরা সেটাই দেখি ।
একাধারে সাম্যের কবি , মানবতার , প্রেমের ,দ্রোহের বিদ্রোহের কবি তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।
বাংলার ,বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী একজন মানুষের মানবিক সত্ত্বা কেমন হতে পারে ,তা নজরুল আমাদের দেখিয়েছেন
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবন ও সাহিত্যর ছবি সহ কাল নির্দেশিকা ।
১৮৯৯- - - ২৪শে মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) বুধবার কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্ম।
বর্ধমান জেলার আসানসোল মুহকুমার তৎকালীন রাণীগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামের ঐতিহ্যমণ্ডিত কাজী পরিবারের এই কুটিরে কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ।
১৯০৮--- ২০শে মার্চ নজরুল এর পিতা কাজী ফকির আহমেদ এর মৃত্যু ।
কিশোর নজরুল ।
১৯১০- - -আর্থিক অভাবে শিক্ষা জীবন বিঘ্নিত - মসজিদের ইমামতি ,মাজারের খাদেমগিরি ইত্যাদি কাজে জীবিকা নির্বাহ ।
১৯১১-১৯১২-- শিয়ারসোল রাজ হাই স্কুলে ভর্তি ও ঐ স্কুল ত্যাগ মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনিস্টিটিউশনে ভর্তি ,দুই বৎসর পাঠ গ্রহন ,কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক্ কে শিক্ষক রুপে লাভ ।
শিয়ারসোল রাজহাই স্কুল এ সামান্য কিছু দিন পড়াশুনা করেছিলেন ।
১৯১৩-- -আসানসোলে রুটির দোকানে চাকরী
পুলিশ ইনিস্পেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ্র সাথে পরিচয় ।
আসানসোল এর সেই রুটির দোকান ।
রফিজউল্লাহ দারোগার পত্নী শামসুন্ননেসা খানম ।
১৯১৪--- ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুল এ ৭ম শ্রেণীতে অধ্যায়ন ।
১৯১৭-- - ৪৯ নং বাঙালী পল্টন এ যোগদান ।
১৯১৯ --- লেখক রুপে নজরুল এর আত্ম প্রকাশ " বাউন্ডেলের আত্ম কাহিনী " ১৩২৬ এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা মাসিক "সাওগাত"
এই বছরে প্রথম কবিতা " মুক্তি " প্রকাশ , বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা ,শ্রাবন (১৩২৬) সংখ্যা । নজরুল তখন করাচি সেনা বাহিনী তে কর্মরত ।
১৯২০ --- করাচি থেকে কলকাতায় আগমন , বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজাফফর আহমেদ এর সংগে বসবাস শুরু । এপ্রিল (বৈশাখ ১৩২৭) থেকে " মোসলেম ভারত" পত্রিকায় " বাঁধনহারা " উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ শুরু, জুলাই থেকে মুজাফফর আহমেদ সংগে নজরুল " দৈনিক নবযুগ "পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত ।
মুজাফফর আহমেদ এর সংগে নজরুল ।
১৯২১--- আলী আকবর খান এর সংগে কুমিল্লা গমন ।সৈয়দা খাতুন এর সাথে প্রনয় বিবাহ ১৮ জুন (৩রা আষাঢ় ,১৩২৩) সৈয়দা খাতুনের নজরুল এর দেয়া নাম " নার্গিস " ।
নার্গিস পরিবার এর সাথে কোন বিষয় এ নজরুল এর বিরোধ এবং ৪ঠা আষাঢ় ভোরে নজরুল এর দৌলতপুর ত্যাগ ,অক্টোবর এ ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লার সাথে নজরুল এর শান্তিনিকেতনে গমন ও রবীন্দ্রনাথ এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ , ডিসেম্বর এর শেষ সপ্তাহে " বিদ্রোহী " রচনা ।
নার্গিস পরিণত বয়সে
১৯২২-- ৬ই জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী তে " বিদ্রোহী " প্রকাশ
এখানে বিদ্রোহী রচনা করেছিলেন ।
১৩২৬ এর কার্তিক সংখ্যা ।" মোসলেম ভারত " এ একই সাথে । মার্চ এ প্রথম ক্যাব গ্রন্থ " ব্যাথার দান প্রকাশ ।
২৬ শে সেপ্টেম্বর " ধুমকেতু " তে কবির আনন্দময়ীর আগমনে এবং ১৩ অক্টবার ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী প্রকাশ ।
২৫ অক্টবার অগ্নিবীণা প্রকাশিত।
৮ই নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুল এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী
২৩শে নভেম্বার কুমিল্লায় নজরুল গ্রেফতার ।
১৯২৩--- ৭ই জানুয়ারী " রাজবন্দীর জবানবন্দী " রচনা
১৬ জানুয়ারী নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত
২২ শে ফেব্রুয়ারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর গীতিনাট্য " বসন্ত" নজরুল এর নামে উৎসর্গিত ।
এপ্রিলে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর জুলুম এর প্রতিবাদ এ নজরুল এর অনশন ৩৯দিন অনশন ভঙ্গ ।
ডিসেম্বর এ নজরুল এর মুক্তিলাভ ।
১৯২৪ --- সালে আশালতা সেন গুপ্তা র সাথে বিবাহ বন্ধনে এবং হুগলীতে ঘর সংসার শুরু ।
প্রমীলা নজরুল এর বিয়ের বেনারসি।
প্রথম পুত্র আজাদ কামালেরজন্ম ও আকিকা উৎসব ।কিছুদিন পর এই সন্তান এর মৃত্যু ।
বিষের বাঁশি ও "ভাঙ্গার গান " প্রকাশিত। এবং ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা ।
১৯২৫--- ফরিদপুর কংগ্রেস এ গান্ধী জির সাথে সাক্ষাৎ ।
চিত্তরঞ্জন এর মৃত্যু তে অর্ঘ্য চিত্তনামা প্রকাশ ।
১০ই নভেম্বর ' The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress " গঠিত হয় । ঐ পার্টির ইস্তেহার নজরুল ঘোষিত ও প্রকাশিত । লাঙল পত্রিকা প্রকাশ এবং সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত ।
১৯২৬--- কৃষ্ণ নগরে বসবাস শুরু , কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পরজয়। সেপ্টেম্বার এ কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল (অরিন্দম খালেদ) এর জন্ম।
কৃষ্ণ নগর কটেজ এর সামনে , নজরুল এর কোলে বুলবুল , সেবিকা , শ্বাশুরি গিরিবালা দেবী এবং প্রমীলা ।
প্রথম গজল রচনা ।বাগিচায় বুলবুলি তুই দিসনে আজি দোল ।
প্রমিলার র কোলে বুলবুল ।
১৯২৭--- মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশন এ যোগদান ও ভাষণ প্রদান ।এই বছর ই আবুল কালাম সামসুদ্দীন এর নজরুলকে যুগ প্রবর্তক কবি " বলে অভিহিত করন। ডিসেম্বার এ " বড়র পিরীতি বালির বাধ" প্রবন্ধ প্রকাশ ।
১৯২৮--- সাওগাত পত্রিকায় ইব্রাহিম খাঁ র পত্রের উত্তরে নজরুল এর বক্তব্য প্রকাশ ।
ফজিলাতুন্নেসা র সাথে প্রথম পরিচয় ও অনুরাগ ।শরৎ চন্দ্রের সংবর্ধনায় নজরুল এর গান রচনা ।সাওগাত এ "নজরুল ই স্থান" কলম প্রবর্তিত ।
এই বিদুষী মহিলার সাথে পরিচয় হবার পর ,উনার জন্য নজরুল গান লিখেন ।
১৯২৯-- - ৯ই অক্টোবর তৃতীয় পুত্র সব্যসাচীর জন্ম ।১৫ ই ডিসেম্বর ,জাতীর পক্ষ হতে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন ।
১৯৩০--- পুত্র বুলবুল এর মৃত্যু , প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দু সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ ।
পুত্র বুলবুল
১৯৩১--- ম্যাডান থিয়েটার এর সুর ভাণ্ডারী নিযুক্ত
১৯শে ডিসেম্বর কলকাতার রঙ্গমঞ্চে " আলেয়া ' প্রদর্শিত ।
২৪শে ডিসেম্বরকনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধের জন্ম।
পুত্র সানি ও নিনি , সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ ।
পুত্র কে লেখা কবির চিঠি
১৯৩২--- আগস্টে স্বদেশী মেগাফোন কোম্পানি র সাথে যুক্ত।
পূজার গান রিলিজ অনুষ্ঠানে " মনে পরে আজ কোন জনমে "
১৯৩৩ --- ধ্রুব চলচিত্রের জন্য গান রচনা , এবং নারদ এর ভুমিকায় অভিনয় ।
প্রতিভা বসু র সাথে গান নিয়ে আলাপ।
১৯৩৩--- ধ্রুব চলচিত্রর মুক্তি।
১৯৩৬--- ফরিদপুর এ মুসলিম ছত্র পরিষদ এর সম্মেলন এ সভাপতিত্ব এবং অভিভাষণ দান ।
১৯৩৮---- কলকাতা বেতার এ " হারামনি , নবরাগ , মালিকা ,এই অনুষ্ঠান সমূহ নজরুল পরিচালিত।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলন এ যোগদান । প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ।
১৯৩৯--- সাপুড়ে ছায়াচিত্রের কাহিনী ও গান রচনা।
১৯৪১--- যতীন্দ্র মোহন বাগচির সভাপতিত্তে কলকাতায় মহাসমারোহে জন্মদিবস উদযাপিত।
৭ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথ এর মৃত্যুর পরপরই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে " রবিহারা ' নামে কবিতা আবৃত্তি ।
নবযুগ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহন।
১৯৪২--- সাল এর ১০ই জুলাই কবি অসুস্থ হয়ে পরেন।
৭ই অক্টোবর কলকাতার লুম্বিনি পার্ক হসপিটাল এ চিকিৎসা ব্যর্থ ।
সেই সময় কবির কিছু লেখা ।
১৯৪৫--- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালইয়ের জাগত্তরিনী স্বর্ণ পদক
জাগোত্তরোণী স্বর্ণ পদক।
১৯৫২--- রাঁচি তে প্রেরন ।
নজরুল এর গাড়ী রাঁচির বাড়ির সামনে।
১৯৫৩--- কবিকে লন্ডন প্রেরন
কবির পাস পোর্ট
লন্ডনে সারে তে চিকিৎসা রত নজরুল।
১৯৬০--- ভারত সরকারের " পদ্মভূষণ" প্রদান ।
পদ্ম ভূষণ পদক ।
১৯৬২--- প্রমীলার মৃত্যু ।
দুই ভাত্র বধূর সাথে নজরুল ।
১৯৬৭---- রাশিয়ান ভাষায় অনুদিত নজরুল রচনা প্রকাশ।
১৯৭২---- স্বাধীন বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাস্ট গঠন এর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান ভারত সফরে কলকাতায় এসে ভারত সরকারের কাছে আবেদন রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মদিন পালন করার, ২৪ শে মে বাংলাদশ এ আনীত।
ঢাকায় আসবার পূর্বে আব্বাস উদ্দিন এর চিঠি প্রমীলা নজরুল কে
বিমানে আগমন।
বিমানবন্দরে মানুষের ঢল
২৫শে মে ৭৩ তম জন্মজয়ন্তী পালিত হয়
ফিরোজা বেগম গান শোনাচ্ছেন কবি কে
ঢাকায় কবিকে দেখতে এসেছেন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু পত্নী ।
১৯৭৫--- কবিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের ডি-লিট উপাধি প্রদান
পেনশন চেক প্রদান
১৯৭৫--- কবিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের ডি-লিট উপাধি প্রদান।
১৯৭৬---- সালে জানুয়ারী মাসে কবিকে বাংলাদেশে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন ।২১ ফেব্রুয়ারিতে ২১ শে পদকে ভূষিত করা হয়।
মৃত্যুর ৭ দিন পূর্বে নজরুল ।
২৪শে মে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রাহমান কবি নজরুল কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মি ক্রেস্ট উপহার দেন ,এবং নজরুল এর চল চল চল সঙ্গীত টিকে বাংলাদেশের রন সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করেন।
২৯শে আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন
অন্তিম শয়নে নজরুল ।।
মোনাজাত করছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রাহমান ।
কবির গানের ভাষায় বলে যাওয়া ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবি কে সমাহিত করা হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল এবং মকবুল ফিদা হুসাইন এর তুলিতে নজরুল।
কবির কিছু ব্যাক্তিগত জিনিস
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা ।
কবির কুরআন শরীফ ।
সাম্যবাদ এর কবি
শিখ ধর্মীয় নেতাদের সাথে কবি ।
লেখায় মগ্ন কবি ।
২০০৯ সালে প্রকাশিত কবির ফ্যামিলি ট্রি ।
কল্যাণীর ভাষায় নজরুল এর শারীরিক উপস্থিতি ছিল বাংলাভাষী দের কাছে প্রেরণার উৎস ।তার চলে যাওয়া দুই বাংলা শোকের সাগরে ভেসেছিল ।কেননা তিনি ছিলেন আমাদের চেতনা তে ছিলেন আমাদের প্রানের কবি ।
তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন উত্তরন এর পথ যতই কঠিন হোক না কেন , চেস্টা , সাধনা আর প্রতিভায় জীবনের চরাই উৎরাই পেরিয়ে ঠিক আসাধারন হয়ে উঠা সম্ভব ।Collected
কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম |
কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে সম্মানিত মুয়াযযিন হিসেবেও কাজ করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে[২] আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরিচ্ছেদসমূহ
জীবনী
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।[১] চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে।[৩] এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে।[১] তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।[১]মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল)[৪] দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ।[১] একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবিকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গিত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন - “ কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। ”
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: "আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ", এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র' সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।[১]
সৈনিক জীবন
সাংবাদিক জীবন ও বিয়ে
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[৫]
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরন করেন। যেমনঃ কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।[৬]
বিদ্রোহী নজরুল
তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে- এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তাঁর মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে "এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে" প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল- এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, "ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী"- নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেনঃ-আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন ।
...
মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
..........................
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।
অসুস্থতা
এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন: রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক- তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন। প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল ছিল অসম্ভব। একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল "ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস" রোগে ভুগছেন। এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফি নামক এক্স-রে করানো হয়। এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে। ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানে হয়েছিল। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন। ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় (সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি)- কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফের অধীনে ভর্তি করানো হয়। এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি- তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন। নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।[৭]
বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণ
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই";- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।
তাঁর জানাজার নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান।[৮] বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সাহিত্যকর্ম
মূল নিবন্ধ: নজরুল রচনা তালিকা
বাংলা ভাষার উইকিসংকলনে এই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত মৌলিক রচনা রয়েছে: লেখক:কাজী নজরুল ইসলাম |
কবিতা
মূল নিবন্ধ: নজরুলের কবিতা
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান
সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।
বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময়
রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা
প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ
হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর
প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত
হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: "প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা" ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তাঁর শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি , লিচু-চোর , খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমান। কবি তার মানুষ কবিতায় বলেছিলেন:পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনতিনি কালী দেবিকে নিয়ে অনেক শ্যামা সঙ্গিত রচনা করেন, ইসলামী গজলও রচনা করেন ।
সঙ্গীত
মূল নিবন্ধ: নজরুলগীতি
নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। নজরুলের গান নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত।গদ্য রচনা, গল্প ও উপন্যাস
নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল "বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী"। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: "হেনা, ব্যাথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে"। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ব্যথার দান- এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়।রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দর্শন
সৈনিক জীবন ত্যাগ করে নজরুল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বাস করছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন এদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। এখান থেকেই তাই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয়। মুজফ্ফর আহমদের সাথে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় অংশ নিতেন। এ সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাথে পরিচিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তার লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ। এরই সাথে প্রকাশ করেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত- তার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রেড ফ্ল্যাগ-এর অবলম্বনে রচিত রক্তপতাকার গান।তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন- অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতারণ। আর খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা, কারণ এই সমন্বিত সুলতানী শাসন ব্যবস্থার প্রধান তথা তুরস্কের সুলতানকে প্রায় সকল মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের খলীফা জ্ঞান করতো। নজরুল এই দুটি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা তথা স্বরাজ অর্জনে বিশ্বাস করতেন যা মহাত্মা গান্ধীর দর্শনের বিপরীত ছিল। আবার মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন তুরস্ক গড়ে তোলার আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল। তারপরও তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন যোগ দিয়েছিলেন। এর কারণ, এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
তবে সব দিক বিচারে নজরুল তার রাষ্ট্রীয় ধ্যান ধারণায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন কামাল পাশার দ্বারা। নজরুল ভেবেছিলেন তুরস্কের মুসলমানরা তাদের দেশে যা করতে পেরেছে ভারতীয় উপমহাদেশে কেন তা সম্ভব হবেনা? গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর। আর তার এই অবস্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল কামাল পাশার। সে হিসেবে তার জীবনের নায়ক ছিলেন কামাল পাশা। নজরুলও তার বিদ্রোহী জীবনে অনুরুপ ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯২১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমদ ও নজরুল তালতলা লেনের যে বাসায় ছিলেন সে বাড়িতেই ভারতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল। ১৯১৭ সনের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেও নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনই এই দলের সদস্য হননি, যদিও কমরেড মুজফ্ফর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আজীবন।
১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণের চেষ্টা করেন। প্রথমে কংগ্রেসে সমর্থন লাভের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু কংগ্রেসের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে তিনি তেমন সাফল্য পাননি। এরপর সাহিত্যের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বহিপ্রকাশ অব্যাহত থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়। [৯]
সম্মান
বাংলাদেশ
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর রচিত "চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গৃহীত। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারীভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট- ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।ভারত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চুরুলিয়ায় "নজরুল অ্যাকাডেমি" নামে একটি বেসরকারি নজরুল-চর্চা কেন্দ্র আছে। চুরুলিয়ার কাছে আসানসোল মহানগরে ২০১২ সালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।[১০][১১] আসানসোলের কাছেই দুর্গাপুর মহানগরের লাগোয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।[১২] উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাজধানী কলকাতার যোগাযোগ-রক্ষাকারী প্রধান সড়কটির নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি। কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার মেট্রো স্টেশনটির নাম রাখা হয়েছেLink: https://en.wikipedia.org/wiki/Kazi_Nazrul_Islam
Link For English
Link For Bengali
My Facebook ID's Link:https://web.facebook.com/jrliton77
www.fb.com/jrliton7
“এই বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”।
কাজী নজরুল ইসলাম -যাকে অনেকগুলি অভিধায় অভিহিত করা হয়- বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, ইসলামী কবি বা মুসলমানের কবি, সাম্যের কবি, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কবি। সবগুলি বিশেষণই তার ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। কিন্তু আমার কাছে তিনি হচ্ছেন, লড়াকু একজন ব্যক্তি যিনি নিজের ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিয়েছিলেন। যিনি হার মানিয়েছিলেন সময়কে, নিজের জন্মগত দুর্ভাগ্যকে। আমার কাছে নজরুল মানে লড়াই করে যাওয়া- সকল পরিস্থিতিতে, সকল স্থানে, সকল সময়ে।
এই দ্রোহ, সাম্য আর প্রেমের কবিও প্রেমে পরেছিলেন। বাজিয়েছিলেন বাশি, লিখেছেন কবিতা, গান, গল্প আর কিছু অসাধারণ চিঠি- রমণীর মন পাবার আশায়। তার জীবনে তিনজন নারীর আগমন সুস্পষ্ট। তারা হলেন-
১। সৈয়দা খানম;
২। প্রমীলা সেনগুপ্তা;
৩। ফজিলতুন্নেসা জোহা।
১। সৈয়দা খানম - ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল
কুমিল্লার দৌলতপুরের বিখ্যান খান বংশের সন্তান আলী আকবর খান। তিনি পেশায় ছিলেন একজন সৈনিক (ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় থাকাকালীন অবসর নেন) এবং পরবর্তীতে একজন গ্রন্থ প্রকাশক। তিনি মূলত শিশু শিক্ষার বই প্রকাশ করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন।
কারো কারো মতে, তাদের পরিচয় হয়, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর, অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে নৌশেরার ট্রেনিং শেষে ১৯১৯ সালের দিকে নজরুল করাচিতে অবস্থান করছিলেন। সম্ভবত তখনই আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। নজরুলের সৈনিক পদমর্যাদা তখন ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার, আলী আকবর ক্যাপ্টেন।
পরিচয়ের শুরু থেকেই তিনি চাচ্ছিলেন, নজরুলকে হাতে কব্জায় রাখতে, কারন শিশু সাহিত্যে নজরুল সিদ্ধহস্ত। তাকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিলে ভালো বাজার পাওয়া যাবে, আর টাকা-পয়সার ব্যাপারে নজরুল চিরকালই উদাসীন। আড্ডাবাজ নজরুল ভালোভাবেই মিশে যান আলী আকবর খানের সাথে কিন্তু নজরুলের বন্ধু কমরেড মোজাফর আহমেদের এটা পছন্দ হচ্ছিলো না, কারন তিনি জানতেন আলী আকবর খান খুব চতুর।
নজরুলের সাথে সম্পর্ক গভীর কিংবা তার উপর প্রভাব বিস্তার করার মানসে আলী আকবর খান নজরুলকে কুমিল্লায় নিয়ে আসেন বেড়ানোর নাম করে। ১৯২১ সালে (বাংলা ২৩ চৈত্র ১৩২৭) নজরুল তার বন্ধুদের না জানিয়েই মুরাদনগরের দৌলতপুরে আসেন। এখানে তাকে দেয়া হয় উষ্ণ সংবর্ধনা, নির্মান করা হয় তোরন।
ছবিঃ দৌলতপুরে এই বাড়িতেই ছিলেন নজরুল।
কলকাতা থেকে ট্রেনে কুমিল্লা আসেন তারা, সেইখানে আলী আকবর খান প্রথমে নজরুলকে নিয়ে উঠেন তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের সাথে থাকতেন তার মা বিরজা সুন্দরী দেবী (যার আদর-ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে নজরুলও মা ডাকতেন ) আর তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তাকে নিয়ে, যিনি দোলন নামেও পরিচিত ছিলেন। চার-পাচদিন এখানে কাটিয়ে তারা দৌলতপুরে চলে আসেন।
খাঁন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে মুন্সী বাড়িতে বিয়ে দেন আলী আকবর খাঁনের বোন আসমতের নেসাকে। বাবার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় এবং আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আসমতের নেসা প্রায়সই বাবার বাড়ি থাকতেন, সেই সাথে তাঁর মেয়ে সৈয়দা খাতুনও। এক পর্যায়ে সৈয়দা খাতুনের বড় ভাই জব্বার মুন্সীর সাথে মামা নেজাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খাঁনমের বিয়ের দিন স্থির হয় ১৯২১ সালের ৫ মে (বাংলা ২২বৈশাখ)। সেই বিয়েতে যোগ দেন নজরুল। জনশ্রুতি আছে এবং ঐতিহাসিকদের মতেও ওই দিনই যুবক নজরুলের প্রথম দেখা হয় ভাইয়ের বিয়েতে আসা ষোড়শী সৈয়দা খাতুনের সাথে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্যতা। নজরুল ইরানী ফুলের নামে তাঁর নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম।নার্গিসের রূপ মাধুরী ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে দৌলতপুরে দীর্ঘ ৭১ দিন অবস্থান করেন নজরুল। অন্য আরেকটি মতে, নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে।
ছবিঃ নার্গিস ফুল।
নার্গিসের প্রতি নজরুলের মুগ্ধতা চোখ এড়ায় না চতুর আলী আকবর খানের। তারই একান্ত ইচ্ছায় ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় নজরুল-নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। ধুমধাম করে বিয়েও হয়, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন সেইখানে। আর নজরুলের পক্ষে তার অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী।
কিন্তু বিয়ের আসর থেকে আকদ হবার পরে পরেই তিনি রহস্যজনক কারনেই তিনি উঠে চলে আসেন। কারো কারো মতে কাবিনের শর্ত নিয়ে ঝামেলার কারনে রগচটা নজরুল রাগ করে চলে আসেন। কাবিনে শর্ত ছিলো তাকে ঘর জামাই থাকতে হবে। সেই যে চলে আসেন তিনি আর ফিরে যাননি দৌলতপুরে। অনেকে মনে করেন, রগ কমলে হয়ত নজরুল ফিরে যেতেন দৌলতপুরে কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবীর প্ররোচনার কারনে আর তার ফেরা হয়নি।
কোন কোন মতে, নজরুলের সাথে নার্গিসের বাসরও হয়েছিলো বলে জানা যায়।
নজরুল চলে যাবার পরও নার্গিস তাঁর জন্য ১৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। এক পর্যায়ে মামাতো ভাই নোয়াজ্জস আলী টুক্কু খাঁন (তৎকালীন ইউপি ভাইস প্রেসিডেন্ট) কোলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছ থেকে এক প্রকার জোর পূর্বকই বিয়ের তালাক নামায় স্বাক্ষর আনেন (১৯৩৭ সালে)। অতঃপর জোর করেই নার্গিসকে বিয়ে দেন ঢাকার হাসানবাদের ছেলে, কবি আজিজুল হাকিমের সাথে। তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে ডা. আজাদ ফিরোজ ইউরোপের মেঞ্চেস্টারে চিকিৎসক এবং মেয়ে শাহানারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নার্গিস মারা যান ১৯৮৫ সালে, তাকে সমাহিত করাহয় ম্যানচেস্টারে।
১৯২৪ সালে নজরুল বিয়ে করেন, প্রমিলা দেবীকে। কিন্তু তিনি কি ভুলতে পরেছিলেন নার্গিসকে, তার প্রথম প্রেমকে?? চলুন জানি তার নিজের মুখেই- তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না- আমি ‘ধূমকেতুর’ বিষ্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না...” ( নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠির অংশ)।
"যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে"।
বলা যায় নার্গিসই একমাত্র নারী, যার কল্যাণে পৃথিবীতে নজরুলের মতো একজন বিখ্যাত কবির সৃষ্টি হয়েছিলো।এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য কবিতা গুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অ-বেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।
২। কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা দেবী - মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর
ছবিঃ প্রমীলা দেবী।
প্রমীলা সেনগুপ্তা বা দোলন বিয়ের পর যার নাম হয় প্রমীলা দেবী তার সাথে নজরুল ইসলামের পরিচয় পর্ব আগেই বর্ণনা করা হয়েছে।
আকবর আলী খান ছাড়া কুমিল্লাতে নজরুলের পরিচিত বলতে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত (কিভাবে পরিচয় আগেই বলা হয়েছে)। তাই নজরুল রাগ করে বিয়ের আসর থেকে উঠেন বীরেন্দ্রকুমারের বাড়িতেই। রাতে তিনি ও বীরেন পায়ে হেটে চলে আসেন, কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। আর বিরজা সুন্দরী দেবী ও অন্যরা (প্রমীলা দেবীসহ) নজরুলের বিয়ে দাওয়াতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন দৌলতপুরে। তারা পরের দিন বাসায় ফেরেন।
দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে এসে এবং কয়েকদিনের মানসিক পরিশ্রমের কারনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেন বাড়ির সবার যত্নে তিনি সেরে উঠেন। এইসময়ই নজরুল কিশোরী প্রমীলার প্রেমে পড়েন। এটা হতে পারে প্রমীলার সেবা যত্নে মুগ্ধ হয়ে কিংবা তার প্রথম প্রেমের স্মৃতি হতে মুক্তি পাওয়ার আকুলতা।
১৮ জুন নজরুল কান্দিরপাড়ে চলে আসেন, আর ৬ জুলাই কমরেড মুজফ্ফর আহমদ কুমিল্লায় আসেন। এতকিছু ঘটে গেলো নজরুল জীবনে তার বন্ধুরা প্রায় কিছুই জানত না, কারন কলকাতা থেকে আসা সব চিঠি আলী আকবর খান লুকিয়ে রাখতেন। যদিও আলী আকবর খান চিঠি দিয়ে নজরুলের বিয়ের কথা কলকাতার প্রায় সবাইকে জানিয়েছেন এবং অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে নজরুলকে চিঠি লিখছিলেন এমনকি অনেকে সংবাদপত্রে অভিনন্দন বার্তা ও কবিতাও প্রকাশ করেছিলেন। ৮ জুন ১৯২১ সালে মুজফ্ফর আহমদ কবিকে নিয়ে কলকাতায় ফিরেন।
ঐ বছরের নভেম্বর মাসের দিকে দ্বিতীয়বারের মত কবি আবার কান্দিরপাড়ে আসেন এবং এক মাস সময় থাকেন। এই সময়ই কবি সৃষ্টি করেন তার অমর সৃষ্টি “বিদ্রোহী” কবিতা, পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে তিনি আবার কুমিল্লা আসেন। এইবার তার যাত্রা নির্বিঘ্ন ছিলো না। হিন্দু বাড়িতে মুসলিম ছেলের আসা যাওয়া বা হিন্দু মেয়ের সাথে তার প্রেম গোঁড়া হিন্দু সমাজের যুবকেরা মেনে নিতে পারে নাই, তাদের আক্রোশে স্বীকার হন তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও হেনস্তা করেন তাকে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।/
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়।
কবি এইসময় বিহার অবস্থানরত হতে গিরিবালা দেবীকে ও প্রমীলা দেবীকে কুমিল্লা পৌঁছে দিতে আসলে তিনি কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার সেই বিখ্যাত জবানবন্দীটি প্রদান করেন।
"আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে..."।
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। হুগলি জেলে থাকাকালে তিনি বন্দিদের উপর রক্ষীদের অন্যায় আচরনের বিরুদ্ধে গিয়ে অনশন করেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে তার করেন, Give up hunger strike, our literature claims you. (এইসময়েই রবীন্দ্রনাথ বসন্ত গীতিনাট্যটি কবিকে উৎসর্গ করেন)। কিন্তু নজরুল অনশন ভাংগলেন না, এমন কি তার আপন মাতা জাহেদা খাতুনও পারেন নি, কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবী পেরেছিলেন তার অনশন ভাঙতে।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সরাসরি কুমিল্লা চলে আসেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কবি চিন্তা করেন তিনি এইবার প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করবেন। কিন্তু প্রথমেই সমস্যা হয়, বিয়ে কোন ধর্মমতে হবে, সিভিল ম্যারিজ আইনে বিয়ে হতে গেলে পাত্র-পাত্রী একই ধর্মের হতে হয়। আবার ইসলাম ধর্মমতে বিয়ে হচ্ছে না, যেহেতু প্রমীলা দেবী তার ধর্ম ত্যাগে রাজী নয়। কিন্তু প্রেম তো জাতি-ধর্ম মানে না। কবি তখন যুক্তি দেন,
“...আহলে কেতাবিদিগের সংগে ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া ইসলাম আইন মনে অসিদ্ধ নয়। এখন কথা হচ্ছে হিন্দুগন ‘আহলে কিতাব’ কিনা? একচলক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব, এ বিয়ে হওয়া সম্ভবত আইন মনে অন্যায় হবে না”।
অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল খুব সাদামাটাভাবে কলকাতায় তাদের বিয়ে হয়। এই বিয়ের পরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ভীষণভাবে খেপে উঠে, অনেক পত্রিকায় (যেমন প্রবাসী পত্রিকা) তার লেখাও নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।
হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
‘হার-মানা-হার’
৩। ফজিলতুন্নেসা জোহা-তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি
নার্গিস ও প্রমীলা দেবী ছিলেন সাধারণ মানুষ, সমাজে তাদের তেমন কোন পরিচয় নাই কাজী নজরুলের প্রেমিকা বা স্ত্রী ছাড়া। কিন্তু ফজিলতুন্নেসা ছিলেন আপনগুনে ভাস্মর। তিনি খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গনিতে স্নাতক প্রথম মহিলা। তিনিই তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান। ছিলেন ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ।
এতো গেলো তার গুনের পরিচয়, কেমন ছিলেন দেখতে তিনি। বিখ্যাত দাবাড়ু, পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ও তৎকালীন সময়ে গনিত বিভাগের শিক্ষিক কাজী মোতাহের হোসেন তার রুপের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্পটু মেয়ে।
নজরুল প্রেমের এই অংশটা মূলত ছিলো, একদিক থেকে। নজরুল নিজেই ভালোবেসে গেছেন, কিন্তু ভালোবাসা পাননি। আর এইপ্রেমের কাহিনী সবারই অজানা থাকত, যদি কাজী মোতাহের হোসেনকে লেখা নজরুলের সাতটি চিঠি না পাওয়া যেত। অবশ্য নজরুল ফজিলতুন্নেসাকেও একটি চিঠি লিখেন এবং তিনি কোন দিন কবিকে এই চিঠির উত্তর দেন নাই। নজরুলের এই প্রেমের স্বাক্ষী মাত্র তিনজন-মোতাহের হোসেন, ফজিলতুন্নেসা ও কবি স্বয়ং।
দুই বছরের বড় মোতাহের হোসেনের সাথে (কবি ডাকতেন মতিহার) পরিচয় ১৯২০-২১ সালে কলিকাতায় হলেও তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ১৯২৭ সালে কবি যখন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেষনে যোগদানের জন্য প্রথমবারের মত ঢাকায় এসে মোতাহের হোসেনের সরকারী বাসা বর্ধমান হাউজে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) আতিথেয়তা গ্রহণ করেন- যেখানে মোতাহের হোসেন পরিবারসহ থাকতেন, আর এই বাসাতেই ফজিলতুন্নেসা বিকেলে আসতেন মোতাহের হোসেনের স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর সাথে বিকেলে গল্প করতে। মোতাহের হোসেন ফজিলতুন্নেসাকে আপন বোনের মত দেখতেন।
১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার আবার যখন কবি ঢাকায় আসেন তখন ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভবিষত বলে দিতে পারেন। তাই তিনি মোতাহের হোসেনকে অনুরোধ করেন কবিকে নিয়ে তার বাসায় যাবার জন্য। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। সেই বাসাতেই মোতাহের হোসেন কবিকে নিয়ে যান এবং তাদের দুইজনের পরিচয় হয় এবং কবি প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পরে যান। সেদিন রাতেই কবি মোতাহেরকে (তারা দুইজন একই ঘরে ঘুমাতেন) ঘুমে রেখে ফজিলতুন্নেসার বাসায় যান এবং প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে যান এবং ফজিলতুন্নেসাকে চিঠি লিখেন কিন্তু কোন উত্তর পাননি। একইসাথে তিনি মোতাহের হোসেনকে একের পরে এক চিঠি (মোট সাতটি) লিখছেন, যার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে ছিলো ফজিলতুন্নেসার প্রতি তার আকুলতার কথা। এই চিঠিগুলো কতখানি মোতাহেরকে লেখা আর কতখানি ফজিলতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে লেখা তা এক গবেষনার বিষয়। এই চিঠিগুলোর একটি থেকে জানা যায় নজরুল তার “সঞ্চিতা” কাব্যসংকলনটি ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফজিলতুন্নেসা অনুমতি দেননি। এটি পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়।
নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে ‘’বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)।
বিদেশে পড়ার সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্র পুত্র সলিসিটর শামসোদ্দোহার সাথে পরিচয় ঘটে এবং তারা উভয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রতিশ্রুত হন। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর (হুমায়ূন আহমদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকীনের দাদু)ঘটকালিতে ফজিলতুন্নেসা ও শামসোদ্দোহার বিয়ে সম্পন্ন হয়। যদিও বাবার অসুস্থতার জন্য তিনি তার পিএইডি সম্পুর্ন না করেই দেশে ফিরেন।
বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি।।
(বিয়ের খবর শুনে নজরুলের লেখা কবিতা)
ফজিলতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কম-বেশি দুই বছর স্থায়ী হয়। কাজী মোতাহের হোসেন এই ব্যাপারে বলেন,
“ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়” ।
ফজিলতুন্নেসা জোহা ১৯৭৬ সালের ২১ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন।
কিছু গুঞ্জন, কিছু মিথঃ
ঢাকার আরও দুই মেয়েঃ
বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দীলিপ রায় ঢাকায় এসে রানু সোম (পরে বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নাম ধারন করেন ) এর গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাকে নজরুল গীতি শেখাতে শুরে করেন। একদিন দীলিপ রায় নজরুলকে রানু সোমের বাসায় নিয়ে যান। পরে নজরুল নিজেই তাকে গান শিখাতে শুরু করেন এবং তাদের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। যা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি এবং ঢাকাতেই কিছু হিন্দু যুবক তাকে আক্রমন করেন।
ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্রের সাথেও নজরুলকে নিয়ে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো।
একজন সম্পাদিকাঃ
“বর্ষবাণী” নামক একটি বার্ষিক পত্রিকা বের করতেন পশ্চিমবজ্ঞের মেয়ে জাহানারা বেগম চৌধুরী (ডাকনাম মীরা), যাতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সব লেখকেরই লেখা ছাপা হয়েছে। মীরার সাথে দার্জিলিং এ গিয়ে নজরুলের পরিচয় হয়।
তার কাছে নজরুলের কয়েকটি কবিতা ও গানের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, যেখানে তাকে নিয়ে লেখা কবির কয়েকটি কবিতাও ছিলো।
দেশখ্যাত একজনঃ
ছবিঃকানন দেবী।
কানন দেবী বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তাকে নিয়ে নজরুলের সাথে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো। তখন বলা হত, নজরুলকে কোথাও পাওয়া না গেলেও কানন দেবীর বাসায় পাওয়া যাবে।
আর এইসব গুঞ্জন সৃষ্টি ও প্রচারে সবসময়ই আগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে, “শনিবারের চিঠি”র সম্পাদক সজনীকান্ত।
প্রথম তিনজনের প্রতি নজরুলের প্রেম প্রমাণিত সত্য, কিন্তু পরের চারজনের ব্যাপারটা মনে হয় নেহাতই গুঞ্জন। তখন অনলাইন পত্রিকা আর ফেইসবুক না থাকলেও মুখরোচক খবর ছড়ানোর মত সম্পাদক আর পত্রিকার অভাব ছিলো না, ছিলো না মানুষেরও।
উপসংহারে বলতে চাই, ভাগ্যিস নজরুল বার বার প্রেমে পড়েছিলেন, না হলে এমন সুন্দর সুন্দর প্রেমের গান আমরা কোথায় পেতাম।
কৃতজ্ঞতাঃ
১।তৌহিন হাসান- নজরুলের পত্রাবলী। মুলত এই বইটা থেকেই ৯০% সাহায্য নেয়া হয়েছে।
২। ইউকিপিডিয়া।
৩।স্মৃতিপটে নজরুল -স্মৃতিকথা; কাজী মোতাহার হোসেন।
৪। নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম: ড. আবুল আজাদ
নজরুল জীবনে নারী। (জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমিকা ও স্ত্রীগণ)
২৫
শে
মে,
২০১৪
রাত
৮:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
“এই বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”।
কাজী নজরুল ইসলাম -যাকে অনেকগুলি অভিধায় অভিহিত করা হয়- বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি, ইসলামী কবি বা মুসলমানের কবি, সাম্যের কবি, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কবি। সবগুলি বিশেষণই তার ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য। কিন্তু আমার কাছে তিনি হচ্ছেন, লড়াকু একজন ব্যক্তি যিনি নিজের ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিয়েছিলেন। যিনি হার মানিয়েছিলেন সময়কে, নিজের জন্মগত দুর্ভাগ্যকে। আমার কাছে নজরুল মানে লড়াই করে যাওয়া- সকল পরিস্থিতিতে, সকল স্থানে, সকল সময়ে।
এই দ্রোহ, সাম্য আর প্রেমের কবিও প্রেমে পরেছিলেন। বাজিয়েছিলেন বাশি, লিখেছেন কবিতা, গান, গল্প আর কিছু অসাধারণ চিঠি- রমণীর মন পাবার আশায়। তার জীবনে তিনজন নারীর আগমন সুস্পষ্ট। তারা হলেন-
১। সৈয়দা খানম;
২। প্রমীলা সেনগুপ্তা;
৩। ফজিলতুন্নেসা জোহা।
১। সৈয়দা খানম - ফুল নেব না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল
কুমিল্লার দৌলতপুরের বিখ্যান খান বংশের সন্তান আলী আকবর খান। তিনি পেশায় ছিলেন একজন সৈনিক (ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় থাকাকালীন অবসর নেন) এবং পরবর্তীতে একজন গ্রন্থ প্রকাশক। তিনি মূলত শিশু শিক্ষার বই প্রকাশ করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন।
কারো কারো মতে, তাদের পরিচয় হয়, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর, অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে নৌশেরার ট্রেনিং শেষে ১৯১৯ সালের দিকে নজরুল করাচিতে অবস্থান করছিলেন। সম্ভবত তখনই আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। নজরুলের সৈনিক পদমর্যাদা তখন ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার, আলী আকবর ক্যাপ্টেন।
পরিচয়ের শুরু থেকেই তিনি চাচ্ছিলেন, নজরুলকে হাতে কব্জায় রাখতে, কারন শিশু সাহিত্যে নজরুল সিদ্ধহস্ত। তাকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিলে ভালো বাজার পাওয়া যাবে, আর টাকা-পয়সার ব্যাপারে নজরুল চিরকালই উদাসীন। আড্ডাবাজ নজরুল ভালোভাবেই মিশে যান আলী আকবর খানের সাথে কিন্তু নজরুলের বন্ধু কমরেড মোজাফর আহমেদের এটা পছন্দ হচ্ছিলো না, কারন তিনি জানতেন আলী আকবর খান খুব চতুর।
নজরুলের সাথে সম্পর্ক গভীর কিংবা তার উপর প্রভাব বিস্তার করার মানসে আলী আকবর খান নজরুলকে কুমিল্লায় নিয়ে আসেন বেড়ানোর নাম করে। ১৯২১ সালে (বাংলা ২৩ চৈত্র ১৩২৭) নজরুল তার বন্ধুদের না জানিয়েই মুরাদনগরের দৌলতপুরে আসেন। এখানে তাকে দেয়া হয় উষ্ণ সংবর্ধনা, নির্মান করা হয় তোরন।
ছবিঃ দৌলতপুরে এই বাড়িতেই ছিলেন নজরুল।
কলকাতা থেকে ট্রেনে কুমিল্লা আসেন তারা, সেইখানে আলী আকবর খান প্রথমে নজরুলকে নিয়ে উঠেন তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের সাথে থাকতেন তার মা বিরজা সুন্দরী দেবী (যার আদর-ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে নজরুলও মা ডাকতেন ) আর তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তাকে নিয়ে, যিনি দোলন নামেও পরিচিত ছিলেন। চার-পাচদিন এখানে কাটিয়ে তারা দৌলতপুরে চলে আসেন।
খাঁন বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে মুন্সী বাড়িতে বিয়ে দেন আলী আকবর খাঁনের বোন আসমতের নেসাকে। বাবার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় এবং আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আসমতের নেসা প্রায়সই বাবার বাড়ি থাকতেন, সেই সাথে তাঁর মেয়ে সৈয়দা খাতুনও। এক পর্যায়ে সৈয়দা খাতুনের বড় ভাই জব্বার মুন্সীর সাথে মামা নেজাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খাঁনমের বিয়ের দিন স্থির হয় ১৯২১ সালের ৫ মে (বাংলা ২২বৈশাখ)। সেই বিয়েতে যোগ দেন নজরুল। জনশ্রুতি আছে এবং ঐতিহাসিকদের মতেও ওই দিনই যুবক নজরুলের প্রথম দেখা হয় ভাইয়ের বিয়েতে আসা ষোড়শী সৈয়দা খাতুনের সাথে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্যতা। নজরুল ইরানী ফুলের নামে তাঁর নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম।নার্গিসের রূপ মাধুরী ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে দৌলতপুরে দীর্ঘ ৭১ দিন অবস্থান করেন নজরুল। অন্য আরেকটি মতে, নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে।
ছবিঃ নার্গিস ফুল।
নার্গিসের প্রতি নজরুলের মুগ্ধতা চোখ এড়ায় না চতুর আলী আকবর খানের। তারই একান্ত ইচ্ছায় ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় নজরুল-নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। ধুমধাম করে বিয়েও হয়, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন সেইখানে। আর নজরুলের পক্ষে তার অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী।
কিন্তু বিয়ের আসর থেকে আকদ হবার পরে পরেই তিনি রহস্যজনক কারনেই তিনি উঠে চলে আসেন। কারো কারো মতে কাবিনের শর্ত নিয়ে ঝামেলার কারনে রগচটা নজরুল রাগ করে চলে আসেন। কাবিনে শর্ত ছিলো তাকে ঘর জামাই থাকতে হবে। সেই যে চলে আসেন তিনি আর ফিরে যাননি দৌলতপুরে। অনেকে মনে করেন, রগ কমলে হয়ত নজরুল ফিরে যেতেন দৌলতপুরে কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবীর প্ররোচনার কারনে আর তার ফেরা হয়নি।
কোন কোন মতে, নজরুলের সাথে নার্গিসের বাসরও হয়েছিলো বলে জানা যায়।
নজরুল চলে যাবার পরও নার্গিস তাঁর জন্য ১৬ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। এক পর্যায়ে মামাতো ভাই নোয়াজ্জস আলী টুক্কু খাঁন (তৎকালীন ইউপি ভাইস প্রেসিডেন্ট) কোলকাতায় গিয়ে নজরুলের কাছ থেকে এক প্রকার জোর পূর্বকই বিয়ের তালাক নামায় স্বাক্ষর আনেন (১৯৩৭ সালে)। অতঃপর জোর করেই নার্গিসকে বিয়ে দেন ঢাকার হাসানবাদের ছেলে, কবি আজিজুল হাকিমের সাথে। তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে ডা. আজাদ ফিরোজ ইউরোপের মেঞ্চেস্টারে চিকিৎসক এবং মেয়ে শাহানারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নার্গিস মারা যান ১৯৮৫ সালে, তাকে সমাহিত করাহয় ম্যানচেস্টারে।
১৯২৪ সালে নজরুল বিয়ে করেন, প্রমিলা দেবীকে। কিন্তু তিনি কি ভুলতে পরেছিলেন নার্গিসকে, তার প্রথম প্রেমকে?? চলুন জানি তার নিজের মুখেই- তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না- আমি ‘ধূমকেতুর’ বিষ্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না...” ( নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠির অংশ)।
"যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে"।
বলা যায় নার্গিসই একমাত্র নারী, যার কল্যাণে পৃথিবীতে নজরুলের মতো একজন বিখ্যাত কবির সৃষ্টি হয়েছিলো।এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য কবিতা গুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অ-বেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।
২। কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা দেবী - মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর
ছবিঃ প্রমীলা দেবী।
প্রমীলা সেনগুপ্তা বা দোলন বিয়ের পর যার নাম হয় প্রমীলা দেবী তার সাথে নজরুল ইসলামের পরিচয় পর্ব আগেই বর্ণনা করা হয়েছে।
আকবর আলী খান ছাড়া কুমিল্লাতে নজরুলের পরিচিত বলতে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত (কিভাবে পরিচয় আগেই বলা হয়েছে)। তাই নজরুল রাগ করে বিয়ের আসর থেকে উঠেন বীরেন্দ্রকুমারের বাড়িতেই। রাতে তিনি ও বীরেন পায়ে হেটে চলে আসেন, কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে। আর বিরজা সুন্দরী দেবী ও অন্যরা (প্রমীলা দেবীসহ) নজরুলের বিয়ে দাওয়াতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন দৌলতপুরে। তারা পরের দিন বাসায় ফেরেন।
দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে এসে এবং কয়েকদিনের মানসিক পরিশ্রমের কারনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেন বাড়ির সবার যত্নে তিনি সেরে উঠেন। এইসময়ই নজরুল কিশোরী প্রমীলার প্রেমে পড়েন। এটা হতে পারে প্রমীলার সেবা যত্নে মুগ্ধ হয়ে কিংবা তার প্রথম প্রেমের স্মৃতি হতে মুক্তি পাওয়ার আকুলতা।
১৮ জুন নজরুল কান্দিরপাড়ে চলে আসেন, আর ৬ জুলাই কমরেড মুজফ্ফর আহমদ কুমিল্লায় আসেন। এতকিছু ঘটে গেলো নজরুল জীবনে তার বন্ধুরা প্রায় কিছুই জানত না, কারন কলকাতা থেকে আসা সব চিঠি আলী আকবর খান লুকিয়ে রাখতেন। যদিও আলী আকবর খান চিঠি দিয়ে নজরুলের বিয়ের কথা কলকাতার প্রায় সবাইকে জানিয়েছেন এবং অনেকেই অভিনন্দন জানিয়ে নজরুলকে চিঠি লিখছিলেন এমনকি অনেকে সংবাদপত্রে অভিনন্দন বার্তা ও কবিতাও প্রকাশ করেছিলেন। ৮ জুন ১৯২১ সালে মুজফ্ফর আহমদ কবিকে নিয়ে কলকাতায় ফিরেন।
ঐ বছরের নভেম্বর মাসের দিকে দ্বিতীয়বারের মত কবি আবার কান্দিরপাড়ে আসেন এবং এক মাস সময় থাকেন। এই সময়ই কবি সৃষ্টি করেন তার অমর সৃষ্টি “বিদ্রোহী” কবিতা, পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে তিনি আবার কুমিল্লা আসেন। এইবার তার যাত্রা নির্বিঘ্ন ছিলো না। হিন্দু বাড়িতে মুসলিম ছেলের আসা যাওয়া বা হিন্দু মেয়ের সাথে তার প্রেম গোঁড়া হিন্দু সমাজের যুবকেরা মেনে নিতে পারে নাই, তাদের আক্রোশে স্বীকার হন তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও হেনস্তা করেন তাকে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।/
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়।
কবি এইসময় বিহার অবস্থানরত হতে গিরিবালা দেবীকে ও প্রমীলা দেবীকে কুমিল্লা পৌঁছে দিতে আসলে তিনি কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার সেই বিখ্যাত জবানবন্দীটি প্রদান করেন।
"আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে..."।
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। হুগলি জেলে থাকাকালে তিনি বন্দিদের উপর রক্ষীদের অন্যায় আচরনের বিরুদ্ধে গিয়ে অনশন করেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে তার করেন, Give up hunger strike, our literature claims you. (এইসময়েই রবীন্দ্রনাথ বসন্ত গীতিনাট্যটি কবিকে উৎসর্গ করেন)। কিন্তু নজরুল অনশন ভাংগলেন না, এমন কি তার আপন মাতা জাহেদা খাতুনও পারেন নি, কিন্তু বিরজা সুন্দরী দেবী পেরেছিলেন তার অনশন ভাঙতে।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সরাসরি কুমিল্লা চলে আসেন। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কবি চিন্তা করেন তিনি এইবার প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করবেন। কিন্তু প্রথমেই সমস্যা হয়, বিয়ে কোন ধর্মমতে হবে, সিভিল ম্যারিজ আইনে বিয়ে হতে গেলে পাত্র-পাত্রী একই ধর্মের হতে হয়। আবার ইসলাম ধর্মমতে বিয়ে হচ্ছে না, যেহেতু প্রমীলা দেবী তার ধর্ম ত্যাগে রাজী নয়। কিন্তু প্রেম তো জাতি-ধর্ম মানে না। কবি তখন যুক্তি দেন,
“...আহলে কেতাবিদিগের সংগে ক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া ইসলাম আইন মনে অসিদ্ধ নয়। এখন কথা হচ্ছে হিন্দুগন ‘আহলে কিতাব’ কিনা? একচলক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব, এ বিয়ে হওয়া সম্ভবত আইন মনে অন্যায় হবে না”।
অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল খুব সাদামাটাভাবে কলকাতায় তাদের বিয়ে হয়। এই বিয়ের পরে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ভীষণভাবে খেপে উঠে, অনেক পত্রিকায় (যেমন প্রবাসী পত্রিকা) তার লেখাও নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলাসেনগুপ্ত দীর্ঘ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকার পরে মৃত্যু বরণ করেন।
হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
‘হার-মানা-হার’
৩। ফজিলতুন্নেসা জোহা-তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি
নার্গিস ও প্রমীলা দেবী ছিলেন সাধারণ মানুষ, সমাজে তাদের তেমন কোন পরিচয় নাই কাজী নজরুলের প্রেমিকা বা স্ত্রী ছাড়া। কিন্তু ফজিলতুন্নেসা ছিলেন আপনগুনে ভাস্মর। তিনি খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গনিতে স্নাতক প্রথম মহিলা। তিনিই তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান। ছিলেন ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ।
এতো গেলো তার গুনের পরিচয়, কেমন ছিলেন দেখতে তিনি। বিখ্যাত দাবাড়ু, পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ও তৎকালীন সময়ে গনিত বিভাগের শিক্ষিক কাজী মোতাহের হোসেন তার রুপের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্পটু মেয়ে।
নজরুল প্রেমের এই অংশটা মূলত ছিলো, একদিক থেকে। নজরুল নিজেই ভালোবেসে গেছেন, কিন্তু ভালোবাসা পাননি। আর এইপ্রেমের কাহিনী সবারই অজানা থাকত, যদি কাজী মোতাহের হোসেনকে লেখা নজরুলের সাতটি চিঠি না পাওয়া যেত। অবশ্য নজরুল ফজিলতুন্নেসাকেও একটি চিঠি লিখেন এবং তিনি কোন দিন কবিকে এই চিঠির উত্তর দেন নাই। নজরুলের এই প্রেমের স্বাক্ষী মাত্র তিনজন-মোতাহের হোসেন, ফজিলতুন্নেসা ও কবি স্বয়ং।
দুই বছরের বড় মোতাহের হোসেনের সাথে (কবি ডাকতেন মতিহার) পরিচয় ১৯২০-২১ সালে কলিকাতায় হলেও তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ১৯২৭ সালে কবি যখন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেষনে যোগদানের জন্য প্রথমবারের মত ঢাকায় এসে মোতাহের হোসেনের সরকারী বাসা বর্ধমান হাউজে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) আতিথেয়তা গ্রহণ করেন- যেখানে মোতাহের হোসেন পরিবারসহ থাকতেন, আর এই বাসাতেই ফজিলতুন্নেসা বিকেলে আসতেন মোতাহের হোসেনের স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর সাথে বিকেলে গল্প করতে। মোতাহের হোসেন ফজিলতুন্নেসাকে আপন বোনের মত দেখতেন।
১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার আবার যখন কবি ঢাকায় আসেন তখন ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভবিষত বলে দিতে পারেন। তাই তিনি মোতাহের হোসেনকে অনুরোধ করেন কবিকে নিয়ে তার বাসায় যাবার জন্য। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। সেই বাসাতেই মোতাহের হোসেন কবিকে নিয়ে যান এবং তাদের দুইজনের পরিচয় হয় এবং কবি প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পরে যান। সেদিন রাতেই কবি মোতাহেরকে (তারা দুইজন একই ঘরে ঘুমাতেন) ঘুমে রেখে ফজিলতুন্নেসার বাসায় যান এবং প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে যান এবং ফজিলতুন্নেসাকে চিঠি লিখেন কিন্তু কোন উত্তর পাননি। একইসাথে তিনি মোতাহের হোসেনকে একের পরে এক চিঠি (মোট সাতটি) লিখছেন, যার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে ছিলো ফজিলতুন্নেসার প্রতি তার আকুলতার কথা। এই চিঠিগুলো কতখানি মোতাহেরকে লেখা আর কতখানি ফজিলতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে লেখা তা এক গবেষনার বিষয়। এই চিঠিগুলোর একটি থেকে জানা যায় নজরুল তার “সঞ্চিতা” কাব্যসংকলনটি ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফজিলতুন্নেসা অনুমতি দেননি। এটি পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করা হয়।
নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে ‘’বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)।
বিদেশে পড়ার সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্র পুত্র সলিসিটর শামসোদ্দোহার সাথে পরিচয় ঘটে এবং তারা উভয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রতিশ্রুত হন। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর (হুমায়ূন আহমদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকীনের দাদু)ঘটকালিতে ফজিলতুন্নেসা ও শামসোদ্দোহার বিয়ে সম্পন্ন হয়। যদিও বাবার অসুস্থতার জন্য তিনি তার পিএইডি সম্পুর্ন না করেই দেশে ফিরেন।
বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি।।
(বিয়ের খবর শুনে নজরুলের লেখা কবিতা)
ফজিলতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগ কম-বেশি দুই বছর স্থায়ী হয়। কাজী মোতাহের হোসেন এই ব্যাপারে বলেন,
“ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়” ।
ফজিলতুন্নেসা জোহা ১৯৭৬ সালের ২১ অক্টোবর মৃত্যু বরণ করেন।
কিছু গুঞ্জন, কিছু মিথঃ
ঢাকার আরও দুই মেয়েঃ
বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দীলিপ রায় ঢাকায় এসে রানু সোম (পরে বিখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করে প্রতিভা বসু নাম ধারন করেন ) এর গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাকে নজরুল গীতি শেখাতে শুরে করেন। একদিন দীলিপ রায় নজরুলকে রানু সোমের বাসায় নিয়ে যান। পরে নজরুল নিজেই তাকে গান শিখাতে শুরু করেন এবং তাদের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। যা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি এবং ঢাকাতেই কিছু হিন্দু যুবক তাকে আক্রমন করেন।
ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্রের সাথেও নজরুলকে নিয়ে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো।
একজন সম্পাদিকাঃ
“বর্ষবাণী” নামক একটি বার্ষিক পত্রিকা বের করতেন পশ্চিমবজ্ঞের মেয়ে জাহানারা বেগম চৌধুরী (ডাকনাম মীরা), যাতে বাংলার শ্রেষ্ঠ সব লেখকেরই লেখা ছাপা হয়েছে। মীরার সাথে দার্জিলিং এ গিয়ে নজরুলের পরিচয় হয়।
তার কাছে নজরুলের কয়েকটি কবিতা ও গানের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়, যেখানে তাকে নিয়ে লেখা কবির কয়েকটি কবিতাও ছিলো।
দেশখ্যাত একজনঃ
ছবিঃকানন দেবী।
কানন দেবী বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তাকে নিয়ে নজরুলের সাথে প্রেমের গুঞ্জন ছিলো। তখন বলা হত, নজরুলকে কোথাও পাওয়া না গেলেও কানন দেবীর বাসায় পাওয়া যাবে।
আর এইসব গুঞ্জন সৃষ্টি ও প্রচারে সবসময়ই আগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে, “শনিবারের চিঠি”র সম্পাদক সজনীকান্ত।
প্রথম তিনজনের প্রতি নজরুলের প্রেম প্রমাণিত সত্য, কিন্তু পরের চারজনের ব্যাপারটা মনে হয় নেহাতই গুঞ্জন। তখন অনলাইন পত্রিকা আর ফেইসবুক না থাকলেও মুখরোচক খবর ছড়ানোর মত সম্পাদক আর পত্রিকার অভাব ছিলো না, ছিলো না মানুষেরও।
উপসংহারে বলতে চাই, ভাগ্যিস নজরুল বার বার প্রেমে পড়েছিলেন, না হলে এমন সুন্দর সুন্দর প্রেমের গান আমরা কোথায় পেতাম।
কৃতজ্ঞতাঃ
১।তৌহিন হাসান- নজরুলের পত্রাবলী। মুলত এই বইটা থেকেই ৯০% সাহায্য নেয়া হয়েছে।
২। ইউকিপিডিয়া।
৩।স্মৃতিপটে নজরুল -স্মৃতিকথা; কাজী মোতাহার হোসেন।
৪। নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম: ড. আবুল আজাদ
No comments:
Post a Comment