শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ এবং প্রতিকার
শিক্ষার্থী
ঝরে পড়ার কারণ এবং প্রতিকার
০৯/০৯/২০২৩
শিক্ষা
মানুষের মৌলিক অধিকার, জাতির মেরুদণ্ড। বলা হয়ে থাকে যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি
তত উন্নত। একটি শিশুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় হতেই। কিন্তু আমদের
দেশে দেখা যায় অধিকাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হতে না হতেই ঝরে পড়ে। তাই,
বাঙালি জাতির উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করা আর সম্ভব হয়ে উঠেনা। কিন্তু, কেন?
একসময়
আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্বল্পোন্নত দেশ ছিলাম। তা থেকে সকল সূচকে আমাদের অভাবনীয়
উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ কারণে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ পেরিয়ে ২০৪১ সালে একটি উন্নত ও
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা এবং মানসম্মত শিক্ষা
নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু সবার জন্য মানসম্মত
শিক্ষা নিশ্চিত করতে ঝরেপড়া একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
ঝরে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য, অভিভাবকের অসচেতনতা, শিশুর যত্নের ঘাটতি,
মেয়ে শিশুকে শিক্ষা না দেয়ার প্রবণতা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিক্ষাক্রমের অসংগতি,
কর্মমূখী শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, বিদ্যালয়ের সময়সূচি, অপ্রতুল সহপাঠক্রমিক
কার্যক্রম, বিদ্যালয়ের দূরত্ব, অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষক-অভিভাবক
সমন্বয়হীনতা সর্বোপরি শিক্ষক সল্পতা।
বিদ্যালয়গুলো
পুনরায় খোলার পর শিক্ষকদের সাথে অভিভাবকবৃন্দের
সমন্বয় সাধন হলেও শিক্ষার্থীদেরকে এখনও পূর্বের ন্যায় আকৃষ্ট করানো যাচ্ছে
না। অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে কোন টিসি না নিয়েই মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
দেখা গেছে শিক্ষকবৃন্দ হোম ভিজিটের মাধ্যমে তাদেরকে পূনরায় বিদ্যালয়মূখী করলেও
নিয়মিত করা যাচ্ছে না। এভাবে অনেকেই ঝরে পড়ছে। আর এই ঝরে পড়ার মূল কারণ হল
দারিদ্র্যতা। দরিদ্র পিতা মাতা সংসারের খরচ যোগানোর জন্য সন্তানদের স্কুলের
পরিবর্তে কাজে প্রেরণ করেন। যাকে বলে শিশুশ্রম। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার শতভাগ
উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থ করলেও তা প্রয়োজনের তুলানায় অপ্রতুল। দরিদ্র পরিবারের
শিশুদের বিদ্যালয়মূখী করতে হলে তাদের পরিবারের আর্থীক সাহায্য বাড়াতে হবে এবং কোন
টিসি ছাড়া ভর্তিকৃত বিদ্যালয় হতে অন্য কোন স্কুল বা মাদ্রাসায় ভর্তি না করার
ব্যবস্থা করতে হবে।
ঝরে
পড়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে অভিভাকদের
অসচেতনতা। দরিদ্র ও অশিক্ষিত পিতা মাতা অজ্ঞতার কারণে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে
চাননা। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ পরিবারগুলো সচ্ছল হলে শিক্ষকগণ কতৃক মা ও অভিভাবক
সমাবেশ করে, উঠান বৈঠক ও হোম ভিজিটের মাধ্যমে এর অনেকটা নিরসন করা সম্ভব হবে।
অপ্রিয়
হলেও সত্য যে, ইদানিং দেখা যাচ্ছে লেখাপড়া ও তার ভবিষ্যত নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীদের
সাথে অভিভাবকগণও হাতাশ। উনাদের কথা লেখাপড়া করে করবেই কি? চাকুরীতো নেই। লাখো
তরুনের আহাজারি। তাই, বেকারত্বের অভিশাপ
থেকে মুক্তি দিতে কর্মমূখী শিক্ষা বাস্থবায়ন এখন সময়ের দাবী। সে লক্ষ্য
বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কর্মমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর পদক্ষেপ
নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
“খেলার
ছলে শিক্ষা, শিক্ষানীতির দীক্ষা” আর একজন শিক্ষকের প্রধান কাজ আনন্দঘন পরিবেশের
মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাদান করা। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের ভৌত
অবকাঠামোগত দিক দিয়ে যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে, উন্নত হয়েছে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে আছে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান ক্ষমতা। আছে বিদ্যুৎ
সংযোগ। আছে কম্পিউটার/ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর। প্রতিটি বিদ্যালয়ে আছেন একজন করে
আইসিটিতে দক্ষ শিক্ষক। কিন্তু, এসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেয় শিশুরা সেই আনন্দঘন
পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগটি পাচ্ছেনা। তার কারণঃ শিক্ষক স্বল্পতা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট
সর্বোপরি আধিকাংশ সময়ই শিক্ষকদেরকে ব্যস্ত
থাকতে হয় অফিশিয়াল বিভিন্ন নির্দেশ পালন, হোম ভিজিট, শিক্ষক অভিভাবক সমিতি ও
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে মীটিং, বিদ্যালয়ের নানাবিধ ফাইল হালফিল করণ,
বিদ্যালয়, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য যথাসময়ে অতি দ্রুততার
সাথে অনলাইনে সাবমীট করণ, উপবৃত্তি, স্টুডেন্ট প্রোফাইল এবং শিক্ষার্থীদের
কোভিড-১৯ টিকা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে তাদের রেজিস্ট্রেশনে সহায়তা
এমনি নানা কাজে। সঙ্গতকারণেই শিক্ষার্থীদের পড়ানোর ব্যাপারে ঘাটতি থেকে যায়।
তাই, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত চিন্তা করে অতিসত্ত্বর প্রতিটি বিদ্যালয়ে
পর্যাপ্ত বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের অফিসিয়াল কাজের জন্য কেরানি নিয়োগ
করা একান্ত জরুরী।
বাংলাদেশের
বিপুল জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য মানসম্মত শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
আর এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাই হবে একজন শিশুর সম্ভাবনা বিকাশের মূল ভিত্তি। শিশুর
শিক্ষার সে ভিত্তিকে দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলার জন্য অবশ্যই প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া
প্রতিরোধ করতে হবে। ঝরে পড়ার হার শতভাগ কমিয়ে আনতে পারলে আমাদের স্বাক্ষরতার হার
আরো বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব
হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। এটি বাস্তবে পরিণত হোক তা
আমাদের সকলেরই প্রত্যাশা।
লেখক
জাহেদুর
রহিম লিটন
শ্রেষ্ঠ
সহকারী শিক্ষক
বানিয়াচং
উপজেলা
প্রধান
শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত)
দাউদপুর
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়
বানিয়াচং,
হবিগঞ্জ
No comments:
Post a Comment