১.
অপরাধী এক বেলজিয়ান
পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সম্পর্কে টেলিভিশনে এক সন্ধ্যায় একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছিল। আয়েশি ভঙ্গিমায় তা দেখছিলেন বেলজিয়ান যুবক মারিও রয়মান্স। হঠা ৎ হতদরিদ্র এক মায়ের কোলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত, হাড্ডিসার এক শিশুকে দেখে আঁতকে উঠলেন
তিনি। মানুষের এমন করুণ চেহারা দেখতে প্রস্তুত ছিল না তাঁর চোখ দুটি। অবাক বিস্ময়ে টেলিভিশনে দেখলেন, কেবল নিজেদের অধিকার বুঝে পাওয়ার দাবি জানাতেই শাসকগোষ্ঠীর কী নির্মম নিষ্পেষণের শিকার হতে হয়েছে এতগুলো মানুষকে। জানলেন, কী জান্তব উন্মত্ততায় ও হিংসায় একটি দেশের সেনাবাহিনী, নিজ দেশেরই মানুষকে ধেয়ে বেড়াচ্ছে হত্যা করার জন্য।
টেলিভিশনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দেখা অনুষ্ঠানটিই যেন কাল হলো রয়মান্সের। মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না ব্যাপারগুলো। মাথায় ঢুকছিল না, মানুষ কীভাবে এত অসহায় অবস্থায় পড়তে পারে!
পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে পেয়ে বসল। কী করবেন কী করবেন ভাবতে ভাবতে ঠিক করে ফেললেন, ব্রাসেলসের গ্যালারি অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি একটি চিত্রকর্ম চুরি করে তা বিক্রি করে সেই টাকা দান করবেন পূর্ব পাকিস্তানের সেই অসহায় শরণার্থীদের কল্যাণে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ । রয়মান্স ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যা করলেন, তা বেলজিয়ামের ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকার ওপরের দিকেই রয়েছে। তিনি চুরি করলেন সপ্তদশ শতকের শিল্পী ইয়োহান ভারমিয়ারের আঁকা ‘দ্য লাভ লেটার’ নামের একটি অসাধারণ তেলচিত্র। ওই সময়ের বাজারমূল্যে যার দাম ধরা ছিল ৫০ লাখ বেলজিয়ান ফ্রাঙ্ক।
সেদিন সন্ধ্যায়ই ব্রাসেলসের গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে উদ্বোধন করা হয়েছিল হল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, জার্মানির ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের শিল্পীদের আঁকা বিভিন্ন তেলচিত্রের প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানে দর্শকবেশেই তিনি ঢুকেছিলেন। অনুষ্ঠানে ছিলেন শেষ অবধি। রাতের বেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্যালারিতে ঢুকে তিনি আলু কাটার ছুরি দিয়ে কেটে ফ্রেম থেকে বের করে আনেন সেই ছবিটি। এরপর গোপন পথ দিয়ে বেরিয়ে সোজা ট্যাক্সি চেপে নিজের বাড়ি। ছবিটি চুরি করে বিপদেই পড়েছিলেন রয়মান্স। কোথায় লুকিয়ে রাখবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। শেষে একদিন কোনো এক পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেন নিজের ‘কীর্তি’র কথা। ইয়োহান ভারমিয়ারের সেই তেলচিত্রটি খুঁজে পেতে তখন লাখ লাখ ফ্রাঙ্ক পুরস্কার ঘোষণা হয়ে গেছে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এই চুরি তিনি নিজের জন্য করেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল,
এর মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবেন। এ জন্য দেনদরবার করতে থাকেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু যেখান থেকে ফোন করে তিনি দরবার করছিলেন, সেখানকারই একজন গোপনে রয়মান্সের কথা শুনে পুলিশে জানিয়ে দেয়। পুলিশ ধাওয়া করে গ্রেপ্তার করে তাঁকে। উদ্ধার করে ভারমিয়ারের ছবিটি। বিচারে দুই বছরের সাজাও দেওয়া হয় রয়মান্সকে।
কিন্তু, গোটা বেলজিয়ামে তখন উল্টো প্রতিক্রিয়া। সত্যিই তো, রয়মান্স তো কোনো অন্যায় করেননি। তাঁর গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে তরুণেরা রাস্তায় নেমে আসে। জনতার দাবির মুখে নতি স্বীকার করে বেলজিয়ান সরকার তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে ছয় মাস করে।
কারাভোগ অবশ্য ক্ষতির কারণ হয় রয়মান্সের জন্য। শরীর ভেঙে যায় তাঁর। তত দিনে অবশ্য বাংলাদেশও স্বাধীনতা পেয়ে যায়। কিন্তু কারাগারে বাস করে মানসিক আঘাত পাওয়া রয়মান্স আর নিজেকে ফিরে পাননি। ১৯৭৮ সালে খুব অল্প বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন।
মারিও রয়মান্সের এই অসাধারণ আত্মত্যাগ তো আমাদের স্বাধীনতার জন্যই। তাঁর কৃতিত্বের কথা জানতে আমাদের ৪০ বছর লেগে গেল।
গ্রন্থনা: নাইর ইকবাল
২.
দুপুর এগারোটা পঞ্চাশ, ফ্রান্সের প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে দাঁড়ানো পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং ৭২০ বিমান. সালটা ১৯৭১; তিন ডিসেম্বর।
২৮ বৎসর বয়সী এই দু:সাহসী ফরাসী যুবক; নাম জ্যঁ ক্যুয়ে। ব্যাগে বোমা ও হাতে রিভলবার নিয়ে বিমানের ককপিটে উঠে পড়েন। পিআইএ-র বোয়িংটির ককপিটে গিয়ে পাইলটের গায়ে ৯এমএম পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি দাবী তোলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে হবে। এই দু:সাহসী যুবক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এই বিমানকে পাঁচ ঘণ্টা রানওয়েতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তার একমাত্র দাবি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত মানুষ বিশেষ করে ভারতে আশ্রয়গ্রণকারী শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কিছু ঔষুধ ওই বিমানটিতে তুলে পাঠাতে হবে। এই অসামান্য ঘটনা টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি প্রচারিত হয়েছিল এবং পরদিন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
আলোচনায় বসা হলো জ্যঁ ক্যুয়ে’র সঙ্গে। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ব্যক্তিগত কোনো লাভালাভের ব্যাপার এখানে নেই। তিনি কেবল চান মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশে যেন ফ্রান্স সরকার ঔষুধ সরবরাহ করে সহায়তা করে। আর পিআইএর এই বিমানে করেই যেন সেই মালামাল বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়।
জ্যঁ ক্যুয়ের দাবিও ফরাসী সরকার সহজে মেনে নেয়নি। কমান্ডো বাহিনী দিয়ে দিয়ে অর্লি বিমানবন্দর ছেয়ে ফেলে ফরাসী সেনাবাহিনী। তবে এক পর্যায়ে বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে সরকার মেনে নেয় তার দাবি। ফরাসী রেডক্রস ও অন্য একটি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় দ্রুত সংগ্রহ করে অর্লি বিমান বন্দরে আনা হয় ১ টন ঔষধ। শেষাবধি পিআইএ-র ঐ বিমানেই তোলা হয় ১ টন ঔষুধ এবং বাকী ঔষধ অনতিবিলম্বে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। বিমানে ঔষধ বোঝাই করার মুহূর্তে মেকানিকের ছদ্মবেশে ২জন পুলিশ উঠে ককপিটে গিয়ে জ্যঁ ক্যুয়েকে আক্রমণ করে বসে এবং কিল-ঘুষিতে কাবু করে গ্রেপ্তার করে ফেলে।
হ্যান্ডকাফ পড়া অবস্থায় বিমান থেকে নামার সময় হাইজ্যাকার ছেলেটার ভাব ভংগী পাল্টে গেল। যেই মুখে বিশাল দাপট নিয়ে কিছুক্ষন আগেই সে ২৮ জন যাত্রী সহ একটি বিমান উড়িয়ে দেয়ার হুমকী দিচ্ছিল, সেই মুখেই সে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো – তার দাবীকৃত মেডিকেল সামগ্রী আর রিলিফ যেনো জায়গামত পৌছে দেয়া হয়। রিলিফটা সত্যিই দরকার। আটমাস হয়ে গেছে তারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে – মেডিকেল এবং রিলিফ তাদের সত্যিই খুব দরকার।
অঁদ্রে দ্য মল্টা নামের একটি সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সেই ঔষুধ অবশ্য বাংলাদেশে পৌঁছানো হয়েছিলো ঠিকই।
জ্যঁ ক্যুয়ের কাছে কোন বোমা ছিল না। যে বাক্সটি তাঁর হাতে ছিল তাতে কেবল কিছু বৈদ্যুতিক তার, বই, এক কপি বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রিক শেভার পাওয়া গিয়েছিল। তবুও বিমান হাইজ্যাকের অপরাধে আদালতে তার বিচার হয়েছিল এবং তার ৫ বছর কারাদণ্ড হয়েছিলো।
গ্রন্থনা: আরিফ রহমান
অপরাধী এক বেলজিয়ান
পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সম্পর্কে টেলিভিশনে এক সন্ধ্যায় একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছিল। আয়েশি ভঙ্গিমায় তা দেখছিলেন বেলজিয়ান যুবক মারিও রয়মান্স। হঠা ৎ হতদরিদ্র এক মায়ের কোলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত, হাড্ডিসার এক শিশুকে দেখে আঁতকে উঠলেন
তিনি। মানুষের এমন করুণ চেহারা দেখতে প্রস্তুত ছিল না তাঁর চোখ দুটি। অবাক বিস্ময়ে টেলিভিশনে দেখলেন, কেবল নিজেদের অধিকার বুঝে পাওয়ার দাবি জানাতেই শাসকগোষ্ঠীর কী নির্মম নিষ্পেষণের শিকার হতে হয়েছে এতগুলো মানুষকে। জানলেন, কী জান্তব উন্মত্ততায় ও হিংসায় একটি দেশের সেনাবাহিনী, নিজ দেশেরই মানুষকে ধেয়ে বেড়াচ্ছে হত্যা করার জন্য।
টেলিভিশনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দেখা অনুষ্ঠানটিই যেন কাল হলো রয়মান্সের। মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না ব্যাপারগুলো। মাথায় ঢুকছিল না, মানুষ কীভাবে এত অসহায় অবস্থায় পড়তে পারে!
পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে পেয়ে বসল। কী করবেন কী করবেন ভাবতে ভাবতে ঠিক করে ফেললেন, ব্রাসেলসের গ্যালারি অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি একটি চিত্রকর্ম চুরি করে তা বিক্রি করে সেই টাকা দান করবেন পূর্ব পাকিস্তানের সেই অসহায় শরণার্থীদের কল্যাণে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ । রয়মান্স ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যা করলেন, তা বেলজিয়ামের ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর অপরাধের তালিকার ওপরের দিকেই রয়েছে। তিনি চুরি করলেন সপ্তদশ শতকের শিল্পী ইয়োহান ভারমিয়ারের আঁকা ‘দ্য লাভ লেটার’ নামের একটি অসাধারণ তেলচিত্র। ওই সময়ের বাজারমূল্যে যার দাম ধরা ছিল ৫০ লাখ বেলজিয়ান ফ্রাঙ্ক।
সেদিন সন্ধ্যায়ই ব্রাসেলসের গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে উদ্বোধন করা হয়েছিল হল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, জার্মানির ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের শিল্পীদের আঁকা বিভিন্ন তেলচিত্রের প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানে দর্শকবেশেই তিনি ঢুকেছিলেন। অনুষ্ঠানে ছিলেন শেষ অবধি। রাতের বেলা বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্যালারিতে ঢুকে তিনি আলু কাটার ছুরি দিয়ে কেটে ফ্রেম থেকে বের করে আনেন সেই ছবিটি। এরপর গোপন পথ দিয়ে বেরিয়ে সোজা ট্যাক্সি চেপে নিজের বাড়ি। ছবিটি চুরি করে বিপদেই পড়েছিলেন রয়মান্স। কোথায় লুকিয়ে রাখবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। শেষে একদিন কোনো এক পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেন নিজের ‘কীর্তি’র কথা। ইয়োহান ভারমিয়ারের সেই তেলচিত্রটি খুঁজে পেতে তখন লাখ লাখ ফ্রাঙ্ক পুরস্কার ঘোষণা হয়ে গেছে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এই চুরি তিনি নিজের জন্য করেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল,
এর মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবেন। এ জন্য দেনদরবার করতে থাকেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু যেখান থেকে ফোন করে তিনি দরবার করছিলেন, সেখানকারই একজন গোপনে রয়মান্সের কথা শুনে পুলিশে জানিয়ে দেয়। পুলিশ ধাওয়া করে গ্রেপ্তার করে তাঁকে। উদ্ধার করে ভারমিয়ারের ছবিটি। বিচারে দুই বছরের সাজাও দেওয়া হয় রয়মান্সকে।
কিন্তু, গোটা বেলজিয়ামে তখন উল্টো প্রতিক্রিয়া। সত্যিই তো, রয়মান্স তো কোনো অন্যায় করেননি। তাঁর গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে তরুণেরা রাস্তায় নেমে আসে। জনতার দাবির মুখে নতি স্বীকার করে বেলজিয়ান সরকার তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে ছয় মাস করে।
কারাভোগ অবশ্য ক্ষতির কারণ হয় রয়মান্সের জন্য। শরীর ভেঙে যায় তাঁর। তত দিনে অবশ্য বাংলাদেশও স্বাধীনতা পেয়ে যায়। কিন্তু কারাগারে বাস করে মানসিক আঘাত পাওয়া রয়মান্স আর নিজেকে ফিরে পাননি। ১৯৭৮ সালে খুব অল্প বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন।
মারিও রয়মান্সের এই অসাধারণ আত্মত্যাগ তো আমাদের স্বাধীনতার জন্যই। তাঁর কৃতিত্বের কথা জানতে আমাদের ৪০ বছর লেগে গেল।
গ্রন্থনা: নাইর ইকবাল
২.
দুপুর এগারোটা পঞ্চাশ, ফ্রান্সের প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে দাঁড়ানো পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং ৭২০ বিমান. সালটা ১৯৭১; তিন ডিসেম্বর।
২৮ বৎসর বয়সী এই দু:সাহসী ফরাসী যুবক; নাম জ্যঁ ক্যুয়ে। ব্যাগে বোমা ও হাতে রিভলবার নিয়ে বিমানের ককপিটে উঠে পড়েন। পিআইএ-র বোয়িংটির ককপিটে গিয়ে পাইলটের গায়ে ৯এমএম পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি দাবী তোলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে হবে। এই দু:সাহসী যুবক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এই বিমানকে পাঁচ ঘণ্টা রানওয়েতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। তার একমাত্র দাবি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত মানুষ বিশেষ করে ভারতে আশ্রয়গ্রণকারী শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কিছু ঔষুধ ওই বিমানটিতে তুলে পাঠাতে হবে। এই অসামান্য ঘটনা টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি প্রচারিত হয়েছিল এবং পরদিন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
আলোচনায় বসা হলো জ্যঁ ক্যুয়ে’র সঙ্গে। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ব্যক্তিগত কোনো লাভালাভের ব্যাপার এখানে নেই। তিনি কেবল চান মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশে যেন ফ্রান্স সরকার ঔষুধ সরবরাহ করে সহায়তা করে। আর পিআইএর এই বিমানে করেই যেন সেই মালামাল বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়।
জ্যঁ ক্যুয়ের দাবিও ফরাসী সরকার সহজে মেনে নেয়নি। কমান্ডো বাহিনী দিয়ে দিয়ে অর্লি বিমানবন্দর ছেয়ে ফেলে ফরাসী সেনাবাহিনী। তবে এক পর্যায়ে বিকাল ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে সরকার মেনে নেয় তার দাবি। ফরাসী রেডক্রস ও অন্য একটি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় দ্রুত সংগ্রহ করে অর্লি বিমান বন্দরে আনা হয় ১ টন ঔষধ। শেষাবধি পিআইএ-র ঐ বিমানেই তোলা হয় ১ টন ঔষুধ এবং বাকী ঔষধ অনতিবিলম্বে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। বিমানে ঔষধ বোঝাই করার মুহূর্তে মেকানিকের ছদ্মবেশে ২জন পুলিশ উঠে ককপিটে গিয়ে জ্যঁ ক্যুয়েকে আক্রমণ করে বসে এবং কিল-ঘুষিতে কাবু করে গ্রেপ্তার করে ফেলে।
হ্যান্ডকাফ পড়া অবস্থায় বিমান থেকে নামার সময় হাইজ্যাকার ছেলেটার ভাব ভংগী পাল্টে গেল। যেই মুখে বিশাল দাপট নিয়ে কিছুক্ষন আগেই সে ২৮ জন যাত্রী সহ একটি বিমান উড়িয়ে দেয়ার হুমকী দিচ্ছিল, সেই মুখেই সে অনুনয় বিনয় করতে লাগলো – তার দাবীকৃত মেডিকেল সামগ্রী আর রিলিফ যেনো জায়গামত পৌছে দেয়া হয়। রিলিফটা সত্যিই দরকার। আটমাস হয়ে গেছে তারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে – মেডিকেল এবং রিলিফ তাদের সত্যিই খুব দরকার।
অঁদ্রে দ্য মল্টা নামের একটি সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে সেই ঔষুধ অবশ্য বাংলাদেশে পৌঁছানো হয়েছিলো ঠিকই।
জ্যঁ ক্যুয়ের কাছে কোন বোমা ছিল না। যে বাক্সটি তাঁর হাতে ছিল তাতে কেবল কিছু বৈদ্যুতিক তার, বই, এক কপি বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রিক শেভার পাওয়া গিয়েছিল। তবুও বিমান হাইজ্যাকের অপরাধে আদালতে তার বিচার হয়েছিল এবং তার ৫ বছর কারাদণ্ড হয়েছিলো।
গ্রন্থনা: আরিফ রহমান
No comments:
Post a Comment