Saturday, August 02, 2014

নক্সী কাঁথার মাঠ - ( তের ) - জসীমউদ্দীন

নক্সী কাঁথার মাঠ - ( তের )

জসীমউদ্দীন

একটি বছর হইয়াছে সেই রূপাই গিয়াছে চলি,
দিনে দিনে দিন নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি।
কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁর, তারা ফিরিয়াছে বাড়ি,

শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি।
স্বামীর বাড়িতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,
তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে।
একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত,
প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত।
ও-গাঁয়ে রূপার ভাঙ্গা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়,
খুটি ভেঙ্গে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথের গায়।
প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি,
তারো চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি।
দুখের রজনী যদিও বা কাটে-আসে যে দুখের দিন,
রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ।
কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ,
কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান!
কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, কেন,, হায় কেন,
মনের মতন কাঁদায় তাহারে “পথের কাঙ্গালী” হেন?
সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা,
দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা।
কোন জালুয়ার মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তার কড়ি,
তারি অভিশাপ ফিরিছে কি তার সকল পরাণ ভরি!
কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিড়েছিল নিজ হাতে,
তাহারই ছোয়া কিম লাগিয়া ছোঁয়া আজ তার জীবনের পাতে!
তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি,
কোন প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি।
নয়ন হইতেউড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা,
যে ব্যথারে সাজু বহিতে পারেনা, আজ তা রাখিবে কোথা?
এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে
আনমনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে -দুপুর কাটিয়া যায়,
সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়।
তবু ত আসেনা। বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে,
পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলায় সন্ধ্যার কাল গোরে।
মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে,
রূপারে তোমরা দেখেছো কি কেঊ,শুধায় সে জনে জনে।
গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে,এত লোক হাটে যায়,
কোন দিন কি গো রূপাই তাদের চক্ষে পড়েনি হায়!
খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে,
রূপাই কোথাও পালাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে।
ভাদ্র মাসেতে পাটের বাপারে কেউ কেউ যায় গাঁর,
নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার।
জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, “দেখ,যখন যেখানে যাও,
রূপার তোমরা তালাস লইও , খোদার কছম খাও,”
বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে,
বূড়ী কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা,
কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা।
চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে,
মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে।
সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে,
তামাক খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে;
“তোমরা কি কেউ রূপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে,
নিটল তাহার গাঠন,কথা কয় ভারে ভারে।”
এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,-
রূপারে যে তারা দেখে নাই কোথা,কেমন করিয়া কয়!
যে গাছ ভেঙ্গেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়,
তারি ডালগুলো ভেঙ্গে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায়?
In Facebook

No comments:

Post a Comment